সারা দেশে গত বছর ৫ হাজার ৬২৯ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭,৮০৯ জন। রেল ও নৌপথেও মৃত্যু হয়েছে ৭০৭ জনের। রোববার সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানায়, যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এছাড়া গত ৩ দিনেও রাজধানীতে মারা গেছেন ৫ জন।
অভাবের সংসারে একটুখানি সহযোগিতা করতে হকার পেশা বেছে নেয়া ১২ বছরের রাকিবের জীবন কেড়ে নেয় গণপরিবহনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। গত বৃহস্পতিবার মগবাজারে রাকিবের রক্তভেজা চিপ্সগুলো এভাবেই পড়ে ছিল রাস্তায়। দুই বাসের রেসারেসিতে মাঝখানে পড়ে প্রাণ যায় তার।
শুক্রবার মাতুয়ালে বাসের ধাক্কায় বাবা-বোন ও বোনা জামাইকে হারিয়ে পাগল প্রায় নজরুল। ক্যান্সার আক্রান্ত মাকে দেখতে এসে প্রাণ দিতে হলো তাদের। দিন কিংবা রাতে এভাবেই প্রতিনিয়ত ঝরছে জীবন প্রদীপ।
যাত্রীকল্যান সমিতির পরিসংখ্যানে ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার স্বীকার হয়েছে ট্রাক। যার শতকরা হার প্রায় ৩১ শতাংশের কাছাকাছি। দুর্ঘটনার দ্বিতীয় শীর্ষ পরিসংখ্যান মোটরসাইকেল। যার হার প্রায় ২৬ শতাংশ।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলেছে, দুর্ঘটনায় পড়া ৭ হাজার ৭৩০টি যানবাহনের তথ্য গণমাধ্যমে পাওয়া গেছে, যার ৩০ দশমিক ৪২ শতাংশ ট্রাক, পিকআপ, লরি ও কাভার্ডভ্যান, ২৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ বাস, ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ নছিমন, করিমন ট্রাক্টর ও লেগুনা, ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ অটোরিকশা, ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা, রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক, ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ কার, জিপ ও মাইক্রোবাস।
মোট দুর্ঘটনার ৫৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়ার ঘটনা। ২২ দশমিক ১৭ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৬ দশমিক ১৩ শতাংশ খাদে পড়ে, ৬ দশমিক ২১ শতাংশ বিভিন্ন কারণে, শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে এবং শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ ট্রেন-যানবাহন সংঘর্ষের।
পরিসংখ্যানের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে পথচারীকে গাড়ি চাপা দেওয়া, ট্রেন যানবাহন সংঘর্ষ, মুখোমুখি সংঘর্ষ, চাকায় ওড়না পেঁচিয়ের নিহতের ঘটনা বেড়েছে। তবে নিয়ন্ত্রণ হায়িয়ে খাদে পড়ার ঘটনা ও অন্যান্য দুর্ঘটনা কমেছে।
যাত্রী কল্যান সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, ২০২১ এ মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩১ দশমিক ৫১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৩৯ দশমিক ২৯ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২০ দশমিক ৩৪ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে।
বেপরোয়া গতি, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, রেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা, ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগকে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
এছাড়া দুর্ঘটনা বন্ধে মোট ১২টি সুপারিশ তুলে ধরে যাত্রী কল্যান সমিতি। সুপারিশগুলো হলো:
১. সড়ক নিরাপত্তায় বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করা।
২. আইনের ত্রুটি চিহ্নিত ও সংস্কার করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা।
৩. সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো, সড়ক মন্ত্রণালয়ে আলাদা সড়ক নিরাপত্তা ইউনিট গঠন।
৪. সড়ক নিরাপত্তায় ইত্যিমধ্যে প্রণীত যাবতীয় সুপারিশমালা বাস্তবায়ন উদ্যোগ নেওয়া।
৫. দেশের সড়ক-মহাসড়কে রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা। জেব্রা ক্রসিং দেওয়া।
৬. গণপরিবহন চালকদের পেশাদার ট্রেনিং ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
৭. সড়ক পরিবহন সেক্টরে অনিয়ম-দুর্নীতি ও চাদাঁবাজি বন্ধ করা।
৮. গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করা।
৯. সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠন করে হতাহতদের দ্রুত উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
১০. দেশব্যাপী চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত মানসম্মত নতুন গণপরিবহন নামানোর উদ্যোগ নেওয়া ।
১১. ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রেনিং একাডেমি গড়ে তোলা।
১২. গণপরিবহনে সেবা ও নিরাপত্তার মান পর্যবেক্ষণের জন্য দেশের সকল মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, জেলা প্রশাসকদের প্রতিমাসে একদিন পরিচয় গোপন রেখে গণপরিবহন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।
করোনা সংক্রমণে ৮৫ দিন গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও বছরজুড়ে সড়ক, নৌ ও রেলপথে দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা দুটোই বেড়েছে।