গোটা বিশ্বের নজর এখন ইউক্রেন সংকটে। দেশটির তিন দিক ঘিরে ফেলেছে রাশিয়ার লক্ষাধিক সেনা। সমর বহর আর অস্ত্র সজ্জায় যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি। উদ্বেগে পশ্চিমাদের ঘুম হারাম।
সত্যিই কি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালাবে, এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিশ্ববাসীর কাছে। তাহলে কি আবারও একটি বিশ্বযুদ্ধের সামনে দাঁড়িয়ে পৃথিবী।
রাশিয়ার জোর দিয়ে বলছে, ইউক্রেনের হামলা চালানোর কোন ইচ্ছে তাদের নেই। কিন্তু দেশটির কথায় বিশ্বাস রাখতে পারছে না পশ্চিমারা। হুশিয়ারি দিয়েছে একটি গুলি হলে পরিণতি ভয়াবহ।
এমন পরিস্থিতিতে এখনো ইউক্রেনকে ঘিরে সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে রাশিয়া, আর পশ্চিমারা বলছে রাশিয়া সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করলে করুণ পরিণতি হবে।
এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে চলছে জোরদার কূটনৈতিক তৎপরতা। এরিমধ্যে দূতিয়ালির কাজ শুরু করেছে ফ্রান্স। দেশটির প্রেসিডেন্ট উড়ে গেছেন ক্রেমলিনে।
একটি প্রশ্ন বারবার ফিরে আসছে মানুষের মনে, সেটি হলো কেন এই পরিস্থিতি। ইউক্রেনের হামলা করা রাশিয়ার জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কেন, পশ্চিমাদের স্বার্থই বা কি?
আসলে এমন প্রশ্নের সরাসরি কোন জবাব নেই। পশ্চিমাদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসের যে দীর্ঘ ইতিহাস, সেটিই নানা সমীকরণে তৈরি করে আসছে বর্তমান ইউক্রেন সংকট।
একটা সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিলো ইউক্রেন। সোভিয়েত ভেঙে যাবার পর ইউক্রেন স্বাধীন দেশের মর্যাদা পেলেও ক্রেমলিনের প্রভাব ছিলো স্পষ্ট।
ক্রেমলিন সব সময়ই চাইতো, সোভিয়েত ভেঙে গেলেও এই ব্লকের নতুন দেশগুলো তাদের অনুগত হয়ে থাকুক। কিছুতেই যাতে পশ্চিমাদের মিত্র না হয়ে উঠে।
সেই সঙ্গে মস্কো চাইতো, পশ্চিমা দেশগুলোও যাতে সাবেক সোভিয়েতের দেশগুলোতে নিজেদের বলয় তৈরির চেষ্টা না চালায়। কিন্তু বাস্তবে সেটিই ঘটেছে।
বিবিসি বলছে, পূর্ব ইউরোপের আরো কিছু কমিউনিস্ট দেশ এবং সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মতো, ইউক্রেনেও দুটি রাজনৈতিক ধারা বেশ স্পষ্ট।
সোভিয়েত থেকে বেরিয়ে ইউক্রেন স্বতন্ত্র স্বাধীন দেশ হওয়ার পর, তাদের ভেতরকার জনগণের মধ্যেও দুই ধরনের রাজনৈতিক ধারা গড়ে ওঠে।
ইউক্রেন রাশিয়ার লাগোয়া দেশ বলে সেখানে অনেক জাতিগত রুশ নাগরিকের বাস। সেই রুশ নাগরিকেরা সব সময় রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকতে চেয়েছে।
অন্যদিকে, বাকিরা ইউরোপসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকতে চেয়েছে। পশ্চিমাপন্থীরা চেয়েছে, ইউক্রেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত হোক। একই সঙ্গে তারা ন্যাটোভুক্ত হোক।
এই বিষয়টি চিন্তায় ফেলে দেয় ক্রেমলিনকে। কারণ, অতীতের ইতিহাস থেকে রাশিয়ার শিক্ষা নেয়া আছে। তারা জানে, সময় সুযোগ পেলেই পশ্চিমারা তাদের আক্রমণ করবে।
সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর একের পর এক ন্যাটোতে যোগ দেয় চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া ও আলবেনিয়া।
এই দেশগুলো একসময় সোভিয়েতের অংশ অথবা ওয়ারশ সামরিক জোটের সদস্য ছিল। এদের সঙ্গে যোগ দিতে চাইছে জর্জিয়া, মলদোভা ও ইউক্রেন।
রুশপন্থী সশস্ত্র মিলিশিয়াদের শক্ত ঘাঁটি আছে এবং রাশিয়া তাদের সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। ওই মিলিশিয়াদের কারণে তারা ন্যাটোতে যোগ দিতে পারছে না।
পশ্চিমারা আক্রমণ করতে চাইলে কৌশলগত কারণে ইউক্রেনকে কব্জায় রাখা বেশ জরুরি। সেটি যাতে না ঘটে তাই রাশিয়া কিছুতেই ইউক্রেন বিষয়ে এক চুল ছাড় দিতে নারাজ।
স্বাধীন ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সংকটের পেছনে আরো কারণ আছে। সেটি হলো ইউক্রেনের দ্বীপ ক্রিমিয়া নিয়ে। যা দুই দেশের সম্পর্কে সবচেয়ে খারাপ দিকে নিয়ে গেছে।
ইউক্রেন যখন সোভিয়েতের অংশ ছিলো, তখন প্রায় দুইশ’ বছর ধরে রাশিয়ার মালিকানায় থাকা ক্রিমিয়া উপদ্বীপকে ইউক্রেনের মালিকানায় দেয়া হয়।
ছেড়ে দিলেও ক্রিমিয়ার ওপর মস্কোর নিয়ন্ত্রণ ছিলো। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর ক্রিমিয়ার ওপর মস্কোর নিয়ন্ত্রণ আর থাকলো না। যা মেনে নিতে পারেনি মস্কো।
২০১৪ সালে ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হন বিক্ষোভের মুখে। দেশ ছেড়ে পালাতেও হয় তাকে। এর জন্য পশ্চিমাদের দুষে আসছে রাশিয়া।
আসলে ইয়ানুকোভিচ রাশিয়া ও পশ্চিমা- দুই ব্লকের সঙ্গে খাতির রেখে চলছিলেন। তাতে অবশ্য কোন আপত্তি করেনি মস্কো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি বদলে যায়।
ইয়ানুকোভিচ ইউরোপীয় ইউনিয়নে যেতে উদ্যোগী হতেই প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করলেন। ফলশ্রুতিতে ইইউ-ইউক্রেন আলোচনা ভেঙে যায়।
তখন ইয়ানুকোভিচের বিরুদ্ধে শুরু হয় গণবিক্ষোভ। তার পতনের পর যারা ক্ষমতায় আসে, তারা এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়, যা প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
এরপর ইউক্রেনের ভেতরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ উসকে দেন পুতিন। বিদ্রোহীরা ইউক্রেন সরকারের বিরুদ্ধে ফেটে পড়ে।
পুতিন এই বিদ্রোহীদের সমর্থন দিতে যে সেনাবাহিনী পাঠান, তারা ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে এবং পুতিন ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার নিজের ভূখণ্ড বলে ঘোষণা করেন।
অনেকের কাছেই প্রশ্ন ভৌগলিকভাবে রাশিয়া এখনো বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ হবার পরও মাত্র ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটারের ক্রিমিয়াকে কেন ইউক্রেনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলো।
সোজা কথায় উত্তর, রাশিয়ার দরকার ছিলো। সারা বছর সচল রাখার মতো উষ্ণ পানির তেমন কোন বন্দর নেই রাশিয়ার। অথচ কৌশলগত কারণে এমন একটি বন্দর তাদের দরকার।
ক্রিমিয়ার সেভাস্তাপোলে রাশিয়ার যে নৌ ঘাঁটি আছে, সেখানে আছে উষ্ণ পানি আছে। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার কৃষ্ণ সাগরে ঢোকার একমাত্র পথও হলো এই বন্দর।
তাই ক্রিমিয়ার অবস্থানগত মূল্য অনেক। ইউক্রেন ন্যাটোতে গেলে সেখানে সচল হবে পশ্চিমা সমর সজ্জা। তেমনটি হলে কৃষ্ণ সাগরে আধিপত্য হারাবে রাশিয়া।
আর রাশিয়া এমনটি কখনই হতে দেবে না। তাছাড়া আগে যতবার রাশিয়াতে বিদেশিরা হামলা করেছে তার সবগুলোই এসেছে উত্তর ইউরোপের সমতল ভূমি দিয়ে।
ইতিহাস বলছে, ১৬০৫ সালে পোলিশরা আক্রমণ চালিয়েছিল এই পথ ধরে। এরপর আসে সুইডিশরা। ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে হামলা চালায় ফরাসিরা।
জার্মানরা রাশিয়ায় অভিযান চালিয়েছে দুবার- ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, আবার ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।
অর্থাৎ, নেপোলিয়নের সময় থেকে হিসাব করলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ে প্রতি ৩৩ বছরে রাশিয়াকে উত্তর ইউরোপের সমতলভূমিতে একবার করে যুদ্ধ করতে হয়েছে।
এই কারণে ওই অঞ্চলের দিকে রাশিয়াকে বাড়তি নজর দিতে হচ্ছে। এজন্য ক্রিমিয়া দ্বীপকে দখলে রাখা অনেকটা রাশিয়ার বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা নীতির অংশ হয়ে আছে।
রাশিয়া মনে করছে, পশ্চিমারা ন্যাটোর বাহিনী দিয়ে চারদিক থেকে রাশিয়াকে ঘিরে ফেলে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে। এ কারণে ক্রেমলিনও পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে।
রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিনের একটাই কথা। যা হবার হয়ে গেছে, ন্যাটো যাতে নতুন করে তার প্রতিবেশী কোন দেশের দিকে আর হাত না বাড়ায়।
নিজের দোরগোড়ায় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র পশ্চিমাদের সামরিক উপস্থিতিকে রাশিয়া সঙ্গত কারণেই এক বিরাট নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।
কিন্তু, পুতিনের বিবেচনাকে আমলে নিতে নারাজ ন্যাটো ও পশ্চিমা নেতা। তাই আর দেরি না করে পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে ইউক্রেনের চতুর্দিকে সেনা সমাবেশ ঘটাতে শুরু করে রাশিয়া।
দেশটির এমন অবস্থানের পেছনে সবচেয়ে বেশি শক্তি জোগাচ্ছে রাশিয়ার জ্বালানি। ইউক্রেনের মধ্য দিয়েই পাইপলাইনে করে রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস যায়।
এই পাইপলাইন বন্ধ করে দিলে ইউরোপের লাখো কোটি ঘরে রান্না বন্ধ হয়ে যাবে। ইইউ দেশগুলো যে পরিমাণ গ্যাস আমদানি করে তার অর্ধেকই আসে রাশিয়া থেকে।
অর্থাৎ সেনাবাহিনী বা বিমান বাহিনী নয়, রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র তার জ্বালানি। আর এ কারণেই জার্মানিসহ বহু দেশ ইউক্রেন সংকট নিয়ে মুখে কুলুপ এটে বসে আছে।
আবার পাল্টা দিকও আছে। ইউক্রেন যদি ন্যাটোতে চলে যায়। তাহলে সেই পাইপলাইনে ওপর নিজেদের কর্তৃত্ব হারাতে পারে রাশিয়া। তেমন কোন পরিস্থিতিও চায় না রাশিয়া।
অন্যদিকে পশ্চিমা ও আমেরিকানদের আশঙ্কা, ইউক্রেন যদি রাশিয়ার দখলে যায়, তাহলে ক্রেমলিন এই পাইপলাইনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে বার বার ব্যবহার করবে।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের ধকল সামাল দেয়ার মতো অবস্থায় নেই করোনাকালে পৃথিবী।
অন্যদিকে, ইউক্রেন পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে প্রকৃত কোন যুদ্ধের সম্ভাবনা এখনো খুব জোরালো নয়। সব পক্ষই সব পরিণতি বিবেচনায় আপোস-মীমাংসা আর শান্তির পক্ষেই।