প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগের জন্য যাঁদের নাম এসেছে এবং সেখান থেকে যাদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে, তাদের সবার নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ করার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা।
একই সঙ্গে সরকার ও রাজনৈতিক দলের সুবিধাভোগী কারও নাম না দেয়ার প্রস্তাব করেছেন তাঁরা। কমিশনে যাতে নারী ও সমাজের পিছিয়ে পড়াদের প্রতিনিধিত্বও থাকে সেই প্রস্তাবও এসেছে। নাম প্রকাশের বিষয়ে আশ্বস্ত করেছে সার্চ কমিটি।
একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ায় সব মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে শনিবার বিশিষ্টজনদের সাথে দুই দফা বৈঠক করে সার্চ কমিটি।
দুই বৈঠকে যোগ দিতে আমন্ত্রন পান ৪০ জন। তবে হাজির হন ২৫ জন। প্রথম বৈঠকে ছিলেন ১৪ জন, দ্বিতীয় বৈঠকে ছিলেন ১১ জন। প্রথম দফা বৈঠকে অংশ নেন আইনবিদ, বিশ্ববিদ্যলয়ের অধ্যাপক, সাবেক আমলা ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণে যুক্ত নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
সকাল ১১টা ২৫ মিনিট থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত প্রথম বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, এ এফ হাসান আরিফ, ফিদা এম কামাল, মনসুরুল হক চৌধুরী, এম কে রহমান, ড. শাহদীন মালিক, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন খান, অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. মাকসুদ কামাল, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মাহফুজা খানম, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ, ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘প্রস্তাব করেছি, কোনো দলীয় সরকারের সময়ে; বর্তমান সরকার হোক বা আগের দলীয় সরকার হোক, সে সময় বিশেষভাবে সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি যাতে নির্বাচন কমিশনে স্থান না পায়’।
প্রায় একই মত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, আমরা প্রত্যেকে আলাদা করে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। বেশির ভাগ মানুষ বলেছি, যারা নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব পাবে তারা যেন আগের কোনো সরকারের আমলে বিশেষ সুবিধাভোগী না হয়।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের মনে হয়েছে, সার্চ কমিটি মন দিয়ে আমাদের কথা শুনেছে। কিন্তু কতটুকু রাখবে সেটা নাম প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা বুঝতে পারবো। আমরা কোনো ধরনের নাম দিইনি। আমরা বলেছি, কীসের ভিত্তিতে নেয়া উচিত, কীসের ভিত্তিতে না নেয়া উচিত’।
আর, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মাহফুজা খানম বলেন, সবাই মোটামুটি এক বাক্যে বলা হয়েছে, সার্চ কমিটি যাদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে, তাদের চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট হতে হবে তিনি যেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ হয়। যে কোনো পেশা থেকেই আসতে পারে। তিনি সরকারি আমলা হোক বা যে কোনো পেশার হোক। তাদের দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানতে পারি তাদের ব্যক্তি চরিত্র, তাদের সততা এবং বাংলাদেশে আজ অর্থের প্রতি মোহ মানুষের অনেক। সেই মোহ যেন তাদের না থাকে।
এদিকে, দুপুর একটার দিকে দ্বিতীয় বৈঠক শুরু হয়ে শেষ হয় বেলা আড়াইটার দিকে। এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক আজকের পত্রিকার সম্পাদক ড. গোলাম রহমান, যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম, একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক ও সিইও মোজাম্মেল বাবু, ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, দৈনিক জাগরণের সম্পাদক আবেদ খান, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, এনটিভির বার্তা প্রধান জহিরুল আলম, দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদক স্বদেশ রায় ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
বৈঠক শেষে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বিএনপিকে সংলাপে ডাকতে সার্চ কমিটিকে প্রস্তাব দিয়েছি। আমি মনে করি নির্বাচন কমিশন গঠনে বিএনপিরও ভূমিকা রাখা উচিত। এ ছাড়া তাদেরও অনুসন্ধান কমিটির কাছে নির্বাচন কমিশনের জন্য নাম পাঠানো উচিত।
তিনি বলেন, রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকবেই। বিএনপি রাজপথে দাবিদাওয়া আদায়ে আন্দোলন করবে, সেটা তাদের অধিকার। তবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিএনপি সংলাপে না বসে ঠিক করেনি।
ইসি নিয়োগে সার্চ কমিটির কাছে আটজনের নাম প্রস্তাব করেছেন তিনি। এরা হলেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বদিউল আলম মজুমদার, সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভুইয়া, সাবেক সচিব শওকাত আলী, খালেদ শামস, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল ও সাবেক আইন সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল।
রাজনৈতিক বিভাজনের এই সময়ে শতভাগ বিতর্কমুক্ত নির্বাচন কমিশন গঠন কঠিন। তবুও আমাদের চেষ্টা করতে হবে কোনো বিতর্কিত লোক যেন নির্বাচন কমিশনে না আসে। পাশাপাশি এখানে গণমাধ্যম থেকেও যেন নাম রাখা হয় তাও বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, গণমাধ্যমের সিনিয়র সাংবাদিকরা নির্বাচন ও নির্বাচন প্রক্রিয়া অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেন। এখানে যাদের নাম দেয়া হয় তাদের নাম যেন কয়েকদিন আগেই গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এতে নামগুলো নিয়ে জনগণের প্রতিক্রিয়া জানা যাবে।
তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় এবং সংখ্যায় কম এমন লোকদের পাশাপাশি নারী প্রতিনিধিত্ব রাখতে হবে। কারণ নির্বাচনে তারা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয়। সেখানে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকলে তারা ভোটদানে সাহস পাবে।
চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, আমরা বলেছি যে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করা হবে। তাতে সার্চ কমিটি যেন যোগ্য ও বিতর্কমুক্তদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে দেন। তাদের নাম যেন গণমাধ্যমেও প্রকাশ করা হয়।
যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, আজকের আলোচনায় আমাদের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব দিয়েছি। সার্চ কমিটিতে যেই ১০ জনের নাম প্রস্তাব করা হবে তারা যেন সাহসী, সৎ, যোগ্য এবং নির্লোভ ব্যক্তি হন। যারা আস্থার জায়গায় আছেন তাদের নাম যেন প্রস্তাব দেয়া হয়। এমনভাবে নতুন কমিশন গঠন করা হোক, যেন কমিশন গঠন হওয়ার পর কমিশনারদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব যেন না থাকে।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, সবার অংশগ্রহণে যেন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয় সে বিষয়ে সার্চ কমিটিকে আমরা বলেছি। একইসঙ্গে ব্যক্তিত্বশীল লোকদের যেন এ কমিশনের সুযোগ দেওয়া হয়, এ প্রস্তাবটিও দিয়েছি।
আজকের পত্রিকার সম্পাদক ড. গোলাম রহমান বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোকে সার্চ কমিটির কার্যক্রমে অংশ নেওয়া উচিত’।
সার্চ কমিটির প্রধান আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বৈঠকে সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সার্চ কমিটির সদস্য হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মুসলিম চৌধুরী, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন এবং কথা সাহিত্যিক অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক।