বরিশাল প্রেসক্লাবের সামনে পদ বঞ্চিত বিএনপি নেতাদের অবস্থান
সদ্য ঘোষিত বরিশাল মহানগর বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটির বিরুদ্ধে পাল্টা অবস্থানের জানান দিয়েছেন বাদ পড়া নেতারা। এরিমধ্যে গত বৃহস্পতিবার অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের করে আলোচনার সৃষ্টি করেছেন তারা। সেই আলোচনা না ঘুচতেই শনিবার পুনরায় শো-ডাউন দিয়েছেন। ওই আহ্বায়ক কমিটিকে বিতর্কিত আখ্যায়িত করে বরিশাল প্রেসক্লাবের সামনে অনানুষ্ঠানিক অবস্থান কর্মসূচিও পালন করতে দেখা গেছে তাদের।
শনিবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে ক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন তারা। এসময় বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট মহসিন মন্টু, আনোয়ারুল হক তারিন, সৈয়দ আকবরসহ মহানগর বিএনপি’র সাবেক কমিটির নেতৃত্বস্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ করে মহানগর বিএনপি’র পদবঞ্চিত নেতাদের পাল্টা অবস্থানের বিষয়টিকে স্থানীয় রাজনীতিতে নয়া মেরুকরন হিসেবে দেখছেন অনেকে।
এদিকে, শনিবার সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নেয়া বিএনপির নেতৃত্বস্থানীয় নেতাদের পক্ষে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট মহাসিন মন্টু। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন পূর্বে মহানগর বিএনপি’র ৪২ সদস্য বিশিষ্ট যে কমিটি হয়েছে সেই কমিটির অন্তত ২০-২২ জন রয়েছেন যারা গত ১৫ বছরে বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন না।
অনেকে আছেন যারা আওয়ামী লীগ ঘরানার লোক। অনেকে আছেন যারা সামাজিকভাবে নিজ এলাকাতেই প্রভাবহীন। অথচ তারাই মহানগর বিএনপিতে পদ পেয়েছেন। এদের দিয়ে আর যাই হোক আন্দোলন সংগ্রাম হবে না। এজন্য আমরা আজ একত্রিত হয়েছি। কেন্দ্রের চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি।
এদিকে, শনিবার শো-ডাউনের পূর্বে গত বৃহস্পতিবার নগরীর প্যারারা রোড এলাকায় মহানগর বিএনপি’র সাবেক সহ-সম্পাদক আনোয়ারুল হক তারিন এর ব্যক্তিগত চেম্বারে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন পদ বঞ্চিত নেতারা। সেখানেও আলোচনার বিষয়বস্তু ছিলো সদ্য ঘোষিত মহানগর বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটি নিয়েছে। বিশেষ করে কমিটিতে বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারের পদ না পাওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পায় আলোচনায়।
এ বৈঠকে বৈঠকে সাবেক সহ-সভাপতি আব্বাস উদ্দীন, সৈয়দ হাসান, মো. আলম, যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ আকবর, আইনজীবী ফোরামের সভাপতি মহসিন মন্টু, শহিদুল ইসলাম, নগর যুবদল সভাপতি আক্তারুজ্জামানসহ নগরীর অন্তত ১০টি ওয়ার্ডের সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকেরা অংশ নিয়েছিলেন। তারা মূলত মহানগর কমিটির সাবেক সভাপতি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারের অনুসারী।
যদিও সভায় উপস্থিত সূত্রমতে, তারা মূলত চা-চক্রের জন্য মিলিত হয়েছিলেন। সেখানে খালেদা জিয়ার রোগমুক্তির জন্য দোয়া করা হয় এবং তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আন্দোলনের কৌশল নিয়ে আলোচনা করা হয়।
তবে সভার অপর সূত্রমতে, সদ্য গঠিত নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে ১২ বছর ধরে নিস্ক্রিয় ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি করার বিষয়ে বেশ কয়েকজন নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য দেন। একই সঙ্গে আগামী দিনে দলে তাঁদের অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা করেন।
বরিশাল মহানগরীর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ভেঙে দিয়ে গত বছরের ৩ নভেম্বর আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্র। কমিটিতে মনিরুজ্জামান খান ফারুককে আহ্বায়ক, আলী হায়দার বাবুলকে ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক ও মীর জাহিদুল কবির জাহিদকে সদস্যসচিব করা হয়।
এরপর আহ্বায়ক কমিটি গত ২২ জানুয়ারি ৪১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে পাঠায়। সেখানে আগের কমিটির ১৭১ সদস্যের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা স্থান পাননি। পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি কেন্দ্রে জমা দেওয়ার পর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তা নিয়ে আপত্তি তোলেন সদ্য বিলুপ্ত কমিটির অন্তত ৩১ নেতা। তারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু তাদের আবেদন আমলে নেওয়া হয়নি।
লিখিত অভিযোগে নেতারা উল্লেখ করেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটির অর্ধেকের বেশি নেতা ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর আর দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। পাশাপাশি বর্তমান সরকারের ১০ বছরের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেননি। তারা নিস্ক্রিয় ছিলেন এবং অনেকে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
আব্বাস উদ্দীন অভিযোগ করেছিলেন, ‘আমরা যারা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে জেল, জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছি, তাদের কাউকে আহ্বায়ক কমিটিতে রাখা হয়নি। এমনকি মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও বিলুপ্ত কমিটির সঙ্গে কোনো ধরনের পরামর্শ করা হয়নি। ঘরে বসে নিজেদের লোকজন নিয়ে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বরিশাল মহানগর ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে বরিশালে ব্যাপক আলোচনা চলছে। মজিবর রহমান প্রায় ৩০ বছর ধরে নগর বিএনপির সভাপতি পদে ছিলেন। সাংসদ, হুইপ ও সিটি মেয়রের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে তাঁর শক্ত প্রভাব রয়েছে।
দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মজিবর রহমানের প্রভাবের কারণে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় অংশটি এবার আহ্বায়ক কমিটি করতে এককাট্টা হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তারা সফল হন। এর আগে ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে সর্বশেষ বিএনপির মহানগর কমিটি দেওয়া হয়।
মজিবর রহমান বলেন, ‘বরিশালে শক্তিশালী বিএনপি আমাদের সম্মিলিত পরিশ্রমের ফসল। আমাকে বাদ দেওয়ার জন্য নাহয় তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। আমি নাহয় দলের দুঃসময়ে নেতৃত্ব দিয়ে অন্যায় করেছি। কিন্তু দলের যারা ত্যাগী নেতা, যারা দুঃসময়ে রাজপথে ছিলেন, জেল-জুলুম, অত্যাচার, মিথ্যা মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন, তারা কী অন্যায় করেছেন।
এদিকে, ‘হঠাৎ বাদ পড়া নেতাদের বৈঠক নিয়ে নগর বিএনপিতে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই ব্যাপক আলোচনা চলছে। অনেকেই বলছেন, বাদ পড়া নেতারা নিজেদের অবস্থান জানান দিতে কর্মপন্থা নির্ধারণে সভায় মিলিত হন।
সূত্রমতে, দলের বাদ পড়া অংশটি মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে অত্যন্ত শক্তিশালী ও ওয়ার্ড পর্যায়ে তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি রয়েছে। নতুন আহ্বায়ক কমিটিতে তারা নিস্ক্রিয় থাকলে দলীয় কার্যক্রম গতিশীল করা দুঃসাধ্য হতে পারে।
তবে বৈঠকের আয়োজক বিলুপ্ত কমিটির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা দলীয়ভাবে কোনো সভা করিনি। মূলত দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম ও রাজনীতি করেছি, এমন নেতারা মিলে একটি চা-চক্র করেছি। তবে সবার মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। আহ্বায়ক, দুজন যুগ্ম আহ্বায়ক নিয়ে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু অন্যদের নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাদের ঘুম থেকে তুলে ঘর থেকে কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। এটি দলের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
ত্যাগী এবং জুলুম ও নির্যাতনের শিকার নেতাদের বাদ দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের অভিযোগ অস্বীকার করে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক বলেন, এখন মাত্র ৪১ জন সদস্য নিয়ে আহ্বায়ক কমিটি হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি যখন হবে, তখন ত্যাগী, যারা বাদ পড়েছেন, তারা স্থান পাবেন। আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর কয়েকজন দলের কর্মসূচিতে আসছেন না, এটি দুঃখজনক।