মুখের দুর্গন্ধ বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি, তা হলো কারো নিঃশ্বাসের গন্ধ যদি নিজে বা আশপাশের কাউকে বাজে অনুভূতি দেয় সেটা।
মুখের এ নিঃশ্বাসের গন্ধটা প্রিজেন্ট হতে পারে আবার আনপ্রিজেন্ট হতে পারে। অথবা ডিজটার্বিংও হতে পারে। যদি আনপ্রিজেন্ট বা ডিসটার্বিং হয় সেক্ষেত্রে আমরা বলি মুখে দুর্গন্ধ আছে।
কুমুদীনি উইমেন্স মেডিকেল কলেজের বিভাগীয় প্রধান ও ডেন্টাল ইউনিট চিফ অধ্যাপক ডা. জালাল উদ্দীন মাহমুদ-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে মুখের দুর্গন্ধ নিয়ে কথা হয় সময় সংবাদের। মুখের দুর্গন্ধ দূর করে দাঁত ও মাড়ির সুরক্ষায় তিনি কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। আসুন জেনে নেই সেসব পরামর্শ-
মুখে দুর্গন্ধ কেন হয় ? কী কী বদঅভ্যাসের কারণে মুখে দুর্গন্ধ হয়?
মুখের দুর্গন্ধের বেশ কয়েকটা কারণ আছে। মুখের ভেতরের কারণে ইন্ট্রাওরাল কজ ও বাহিরের কারণে এক্সট্রাওরাল কজের ফলে মুখে দুর্গন্ধ হয়ে থাকে।
দন্ত বিশেষজ্ঞ হিসেবে অধ্যাপক ডা. জালাল উদ্দীন মাহমুদ বলেন, মুখের স্বাস্থ্য সঠিকভাবে পরিচর্যা না করা হলে মুখের ভেতরে দুর্গন্ধ দেখা দেয়। দাঁত ও মুখ যদি ঠিকভাবে পরিষ্কার না করা হয় সেক্ষেত্রে খাবারের কনা মুখের ভেতর জমে থাকবে। পরে জমে যাওয়া খাবার পচে সেই খাবার থেকে গ্যাস তৈরি করে। যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ভোলাটাইল সালফার কম্পাউন্ড বলা হয়। সে গ্যাসটাই মুখের দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে। এ ছাড়া মাড়িতে যে প্রদাহ হয় সেটা পরবর্তীতে প্রোটিনকে ব্রেকডাউন করে মুখে দুর্গন্ধ তৈরি করে। মুখের ক্রাউন ও ডেনচারের নিচে খাবার জমেও দুর্গন্ধ হতে পারে।
এ ছাড়া আরও কিছু কারণ আছে, যেমন জিহ্বা। জিহ্বা আমাদের মুখের একটা বড় অংশ। জিহ্বার উপরের অংশটা রাফ হওয়ায় সেখানে টেস্টবার থাকে, পেপিলা থাকে। ওইসব জায়গায় খাবার জমে ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করতে পারে। ড্রাই মাউথ বা জেরোস্থেমিয়ার কারণে ন্যাচারাল ক্লিন না হলে মুখে দুর্গন্ধ হয়। এসব ইন্ট্রাওরাল কজ হিসেবে পরিচিত।
কান, নাক ও ঠোঁট ইনফেকশন, চোয়ালের কিছু গহ্বরের সাইনোসাইটিজের ইনফেকশনেও মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। লিভার, কিডনি ও খাদ্যনালীর সমস্যার কারণেও মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। এসব এক্সট্রাওরাল কজ হিসেবে পরিচিত।
কী কী বদঅভ্যাসের কারণে মুখে দুর্গন্ধ হয়?
রাতে ঘুমানোর আগে অলসতাবশত দাঁত ব্রাশ না করে ঘুমিয়ে গেলে মুখে দুর্গন্ধ হয়। যারা অতিরিক্ত ধূমপান করেন কিন্তু ঠিকমতো মুখ পরিষ্কার করছেন না, কুলি করছেন না তাদের মুখেও দুর্গন্ধ হয়।
মুখের দুর্গন্ধ এড়াতে কী কী করণীয়?
মুখের দুর্গন্ধ এড়াতে প্রথমেই ওরাল হাইজিংটাকে সঠিকভাবে পরির্চযা করতে হবে। রাতে ঘুমানোর আগে দাঁত ব্রাশ করে ঘুমাতে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে কুলি করে নাস্তা করতে হবে। এবং নাস্তা করার পর আবার দাঁত ব্রাশ করতে হবে। ব্রাশ করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে দুই দাঁতের মাঝখানে যেন খাবার জমে না থাকে। ভালোভাবে দাঁতের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাগুলো পরিষ্কার করতে হবে। মুখের সুগন্ধ আনতে ডিসপেনসারিতে কিছু মাউথ ওয়াশ পাওয়া যায় তা ব্যবহার করলে মুখের দুর্গন্ধ এড়ানো সম্ভব।
মুখের দুর্গন্ধ রোধে কী কী বর্জনীয়?
মুখের দুর্গন্ধ রোধে কিছু খাবারের ক্ষেত্রে সর্তক থাকতে হবে। রসুন ও কাঁচা পেঁয়াজ প্রয়োজনের বেশি খাওয়া যাবে না। ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য পরিহার করতে হবে। পান, সুপারি ও বিভিন্ন প্রকার জর্দা খাওয়া বন্ধ করতে হবে। এবং ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য খাওয়ার পর ঠিকমতো মুখ পরিষ্কার করে কুলি করে ফেলতে হবে।
কী কী শারীরিক সমস্যার কারণে মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে?
ডা. জালাল উদ্দীন মাহমুদের মতে, এক্সট্রাওরাল কজ- নাক কান ও ঠোঁটের ইনফেকশনের কারণে মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। খাদ্যনালীর কোনো সমস্যার কারণে মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। চোয়ালের কিছু গহ্বরের সাইনোসাইটিজের ইনফেকশনের কারনে মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। লিভার ডিজিজের কারনে মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। কিডনির সমস্যা ও ডায়বেটিসের কিটন সমস্যায় মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে।
ডাক্তারের কাছে কখন যাওয়া উচিত?
আপনি যখনই টের পাবেন আপনার মুখে দুর্গন্ধ হয়েছে তখনই ডাক্তারের কাছে আসা উচিত। কেননা, মুখের এ দুর্গন্ধ আপনাকে মানসিক ও ব্যক্তিত্বের দিক থেকে ছোট করে রাখবে। যখনই দেখবেন আপনার আশপাশের মানুষ বা বন্ধুরা আপনার মুখ থেকে বাজে গন্ধ পাচ্ছে তখনই ডাক্তারের পরামর্শ নেন।
মুখের দুর্গন্ধ নিজে কীভাবে বুঝবেন?
খুব সাধারণ কিছু টেস্ট করলেই আপনি নিজেই আপনার মুখে দুর্গন্ধ আছে কিনা বুঝতে পারবেন।
১. আপনার হাতের তালু মুখের কাছে নিয়ে মুখ থেকে হাওয়া ছাড়লে, নাকে সেই হাওয়ার ঘ্রাণ শুকলেই আপনি বুঝবেন আপনার মুখে গন্ধ আছে কিনা।
২. হাতের তালুর উপরিভাগে জিহ্বা দিয়ে চেটে, পরে তা শুকিয়ে গেলে নাক দিয়ে ঘ্রাণ নিয়েও যাচাই করতে পারেন।
৩. একটা চায়ের চামচ নিয়ে তা জিহ্বার নিচে দিয়ে বের করে আনবেন। পরে চামচটা শুকিয়ে গেলে তার ঘ্রাণ শুকেও বুঝতে পারবেন মুখে দুর্গন্ধ আছে কিনা।
শিশুদের মুখে দুর্গন্ধ কেনো হয়?
শিশুরা সাধারণতো ছয় মাস বুকের দুধ খেয়ে থাকে। এবং পরে বুকের দুধের পাশাপাশি জুস ও লিকুইড জাতীয় খাবার খায়। বেশিরভাগ মায়েরা বাচ্চার বুকের দুধ, জুস বা লিকুইড খাবারের পর মুখ পরিষ্কার করে দেন না। এতে শিশুর মুখে ব্যাকটেরিয়া জমে মুখে দুর্গন্ধ তৈরি করে।
মুখের দুর্গন্ধ রোধে কী খাদ্যাভাস রাখা প্রয়োজনীয়?
মুখের দুর্গন্ধ থেকে সুরক্ষার জন্য সবজি জাতীয় জিনিস খাওয়া উচিত। বেশি করে ফলমূল খাওয়া উচিত। যা দাঁতের সারফেসটাকে ঘঁষা দিয়ে দাঁতের মাড়ি ও দাঁতকে পরিষ্কার রাখবে। প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে। যাতে ওয়াশ আউট হয়ে দাঁত পরিষ্কার হয়ে যায়।
মুখের দুর্গন্ধ কী শুধুই দুর্গন্ধ নাকি মারাত্মক রোগের পূর্বাভাস?
মুখের দুর্গন্ধ অনেক সময় মারাত্মক রোগের পূর্বাভাস হিসেবে দেখা দেয়। লিভার ডিজিজ থাকলে মুখের দুর্গন্ধ হতে পারে। কিডনি ইনসাফিসিয়েন্স থাকে তাহলে ইউরিক এসিড বেড়ে গিয়ে মুখের দুর্গন্ধ হতে পারে। খাদ্যনালীতে কোন ইনফেকশন থাকলে মুখের দুর্গন্ধ হতে পারে।
মুখের দুর্গন্ধ কী সাময়িক নাকি দীর্ঘমেয়াদি?
সাধারণতো খাদ্যজনিত কারণে মুখের দুর্গন্ধ হয়ে থাকলে তা সাময়িক। আর অন্য কোনো সমস্যার কারণে হলে তা দীর্ঘদিন থাকতে পারে। তবে সঠিক চিকিৎসায় তাও দ্রুত দূর হয়ে যায়।
মাউথ ফ্রেশনার কতটা কার্যকরী?
মাউথ ফ্রেশনার সাময়িকভাবে পরিত্রাণ দিতে পারে। সঠিক কারণ বের করে চিকিৎসা করে তা দূর করতে হবে। তা না হলে শুধু মাউথ ফ্রেশনার ব্যবহার করে মুখের দুর্গন্ধ থেকে পরিত্রাণের সুযোগ নেই।
ডায়বেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে মুখের যত্ন কীভাবে নেবেন?
তাদের নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করতে হবে। ওরাল হাইজিং ইমপ্রুভ করতে হবে। দাঁতের যত্ন নিতে হবে। মুখের দুর্গন্ধে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।