ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় বর্তমানে পুরো বিশ্বই নানামুখী সংকটে রয়েছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের পাশাপাশি এ লড়াই প্রভাব ফেলছে পুরো বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তাতেও।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় হুমকি সৃষ্টি হয়েছে। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে খাদ্য নিরাপত্তার হুমকিতে পড়বে পুরো বিশ্বই। বিশেষ করে খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোর বিপদ বাড়বে সবচেয়ে বেশি। কারণ রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় খাদ্য উৎপাদক ও রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
এ পরিস্থিতিতে সরব হয়েছে জাতিসংঘও। ইউক্রেন যুদ্ধ প্রভাব ফেলবে জাতিসংঘ পরিচালিত বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিতে। বিশ্বের অনাহারি মানুষের জন্য পরিচালিত খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিও বিঘ্নিত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা।
ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধ বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির সম্মুখীন করছে বলে ইতোমধ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুটেরেস। বিশেষ করে স্বল্পোন্নত ও গরিব রাষ্ট্রগুলো এই সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সোমবার (১৪ মার্চ) একটি সংবাদ সম্মেলনে গুটেরেস বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল আফ্রিকা ও অন্যান্য অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো।
বিশ্বের গমের এক তৃতীয়াংশ উৎপাদন করে রাশিয়া ও ইউক্রেন। পাশাপাশি দেশ দুইটি বিশ্বের সূর্যমুখী তেলের অর্ধেক উৎপাদন করে থাকে। এছাড়া বিশ্ব খাদ্য সংস্থার আওতায় বিতরণ করা গমের অর্ধেকই সরবরাহ করে ইউক্রেন।
বিশ্বের স্বল্পোন্নত ও আফ্রিকার ৪৫টি দেশ কমপক্ষে তাদের চাহিদার এক তৃতীয়াংশ গম আমদানি করে ইউক্রেন অথবা রাশিয়া থেকে। এর মধ্যে ১৮টি দেশ আমদানি করে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ গম। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বুরকিনা ফাসো, মিশর, ডেমোক্রাটিক রিপাবলিক অব কংগো, লেবানন, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান এবং ইয়েমেন।
ইতোমধ্যেই এ দেশগুলোসহ আফ্রিকার খাদ্য আমদানি নির্ভর দেশগুলোতে বাড়াতে শুরু করেছে গমের দাম। পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন থেকেই খাদ্য মজুদ বাড়ানোর ব্যবস্থা নিচ্ছে গম আমদানির ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো। সোমবার (১৪ মার্চ) আলজেরিয়া তাদের দেশ থেকে খাদ্য রফতানি নিষিদ্ধ করেছে। একই পদক্ষেপ নিয়েছে মিশর।
এদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারের দাম বৃদ্ধি পেলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের অনেক কৃষকই তাদের জমি চাষ করতে পারবেন না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রাশিয়ার সার ও কয়লা ব্যবসায়ী বিলিয়নার ব্যবসায়ী আন্দ্রেই মেলনিচেঙ্কো। তাই অচিরেই যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তির জন্য আহ্বান জানান তিনি।
মেলনিচেংঙ্কোর মালিকানাধীন ইউরোচেম বিশ্বের বৃহত্তম পাঁচটি সার কোম্পানির মধ্যে অন্যতম। তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই সারের দাম বাড়তে শুরু করেছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই তা কৃষকদের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও সারা বিশ্বে খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, যদি পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার সার রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, তবে সারা বিশ্বেই বেড়ে যাবে সারের দাম। যা বিঘ্নিত করবে পুরো বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তাকে। রাশিয়া একাই বিশ্বের ১৩ শতাংশ সার উৎপাদন করে থাকে। রাশিয়া বিশ্বের পটাশ, ফসফেট এবং নাইট্রোজেন সম্বলিত সারের প্রধান উৎপাদক।
রোম ভিত্তিক ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অরগানাইজেশন (ফাও) বলেছে, এ যুদ্ধের ফলে সামনের দিনগুলোতে ইউক্রেনের কৃষকরা তাদের ফসল মাড়াই করতে পারবেন কি না, সে বিষয়টি পরিষ্কার নয়। পাশাপাশি রাশিয়ার খাদ্য রফতানি নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। এই দুইটি বিষয় চাপ সৃষ্টি করবে খাদ্য সরবরাহ কার্যক্রমে।
ফাও জানিয়েছে খাবারের দাম বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি প্রবণতা দেখা যাবে উত্তর আফ্রিকা, সাব সাহারান এবং এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে। এই পরিস্থিতিতে ফাও বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি রফতানি নিষেধাজ্ঞা না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এর ফলে খাদ্যের দামে অস্থিরতা বেড়ে যাবে বলে হুশিঁয়ারি দিয়েছে তারা।
ইউক্রেন সংকটের শুরুর পর বিশ্বে গমের দাম বেড়ে গেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। শিকাগো বোর্ড অব ট্রেড এর হুইট কন্টিনিউয়াস কনট্রাক্ট ফিউচার প্রতি বুশেল বিক্রি হচ্ছে ১১ ডলারে। অথচ ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে প্রতি বুশেল গম আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি হত ৮ ডলারে। ৩৭ দশমিক ৭ বুশেলে এক টন ধরা হয়।