সময়টা ১৯১৫ সাল। ২৮ নাবিক নিয়ে স্যার আর্নেস্ট শেকেলটন তার জাহাজ এইচএমএস ইন্ডিউরেন্স ভাসালেন সমুদ্রে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অ্যান্টার্কটিকার বরফের মহাদেশে সাগরে আটকে যায় সেই জাহাজ। কয়েক সপ্তাহ চেষ্টার পরও বরফ থেকে জাহাজটিকে বের করতে না পারায় নাবিকদের নিয়ে জাহাজ থেকে বরফের উপরেই ‘ল্যান্ড স্টেশন’ বানান শেকেলটন। জনমানবশূন্য হাজার মাইল দূরের মহাদেশে কঠিন পরিস্থিতিতে শেকেলটনের দৃঢ় নেতৃত্ব নাবিকদের সাহস বাড়িয়ে দেয়। সমুদ্র বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে চালান গবেষণা।
এই সময়গুলো নাবিকদের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। পরবর্তীতে শেকেটনের প্রকাশিত বই “সাউথ”- এ ছবিসহ সবকিছু প্রকাশিত হয়। এই আভিযাত্রিক দলের অফিসিয়াল ফটোগ্রাফার ছিলেন ফ্রাঙ্ক হার্লি, যিনি এইসব ঘটনার ছবি তুলে রেখেছেন। শীতের তীব্র ঝড় আর অন্ধকারের মাঝেই নাবিকরা বেশ কয়েকবার জাহাজটিকে বরফ থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু জাহাজটি বরফেই আটকে থাকে। এরপর নভেম্বর মাস চলে আসলে, বরফ ছুটতে থাকে এবং বরফের চাপে জাহাজ এক পাশে হেলে পড়ে। এতে জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ভেতরে পানি ঢুকতে শুরু করে। ফলে জাহাজটি ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের কোনো মাধ্যম নেই, মানব সভ্যতা থেকে হাজার মাইল দূরে বসে ইন্ডিউরেন্সের নাবিকরা বরফের সাগরে আস্তে আস্তে জাহাজের ধ্বংস চিত্র দেখতে থাকেন। কয়েক সপ্তাহ পর জাহাজটি পুরোপুরি ডুবে যায়। এরইমধ্যে কিছু কুকুর এবং বিড়ালকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন বস শেকেলটন। যেন এদের দেখভালের ঝামেলা কমে যায়।
কেউ কেউ এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে থাকেন। তবে যেহেতু তাদের সবার উদ্দেশ্য ছিলো তীরে পৌঁছানো তাই কেউই তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেনি। এপ্রিল ১১, ১৯১৬ সাল। শেকেটলন এবং তার নাবিকরা লাইফবোটে চড়ে বসেন। সাগরের বরফশীতল পানিতে কয়েকদিন এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায় তাদের ছোট বোটগুলো। অবশেষে ১৫ এপ্রিলে ১৮ মাস পর সফলভাবে তারা মাটিতে পা রাখে। অ্যান্টার্কটিকার জনমানবহীন এলিফ্যান্ট দ্বীপে পৌঁছান তারা।
এর কয়েকদিন পরই শেকেলটনের নাবিকদের মানসিক ও শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে, শেকেলটন, তার জাহাজের প্রধান ক্যাপ্টেন ওয়ার্সলি এবং রাজমিস্ত্রি হ্যারি ম্যাকনিশ তাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যাত্রা শুরু করেন। ছোট লাইফবোটটিতে চড়ে ৮০০ মাইল পাড়ি দিয়ে সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে পৌঁছান। ২২ ফুট দীর্ঘ এই লাইফবোটটিতে চড়ে ১৬ দিন সমুদ্রের পাহড়সম ঢেউয়ের সাথে টেক্কা দিয়ে টিকে থাকেন। এরমধ্যে শেকেলটনসহ বাকি যারা ৪ জন উদ্ধারের কাজ করতে বেরিয়ে যান। তবে ঝড়ো সমুদ্র ও বরফের কারণে এলিফ্যান্ট দ্বীপের বাকী ২২ জনকে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হতে থাকে।
তবে অদম্য শেকেলটন হার মানতে নারাজ ছিলেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ৩০ আগস্ট এলিফ্যান্ট দ্বীপে পৌঁছায় উদ্ধারকারী দল। সেকেন্ড ইন কমান্ড ফ্রাঙ্ক ওয়াইল্ডের নেতৃত্বে সেখানে ক্যাম্প করে অবস্থান করছিলেন তারা। তাদের খাবারের রেশনও প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো। একজন নাবিকও এই অভিযানে মারা যায়নি। এরপর সেখান থেকে তারা চিলির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। অবশেষে ১৯১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর চিলির বন্দর শহর পুটনা এরিনাতে পৌঁছান তারা। সেখান থেকে সারাবিশ্বের প্রতি সমর্থন ও সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ জানায় নাবিক দল। শেকেলটনের মিশনটি ব্যর্থ হয়েছিলো, কিন্তু তার সকল নাবিককে জীবিত ফিরিয়ে আনার সফলতা তাকে কিংবদন্তিতে পরিণত করে।
সম্প্রতি সেই ১০৭ বছর পুরনো জাহাজটি সমুদ্রের তলদেশ থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। সাগরের প্রায় দুই মাইল তলদেশে অবস্থিত জাহাজটি প্রায় অক্ষত অবস্থায়ই আছে। ডুবে যাওয়ার সময় থেকে জাহাজের অবস্থা কিছুটা বদলে গেছে। এই জাহাজ ও তার নাবিকদের কাহিনী হাজারও দামি পাথর বা স্বর্ণমুদ্রার চেয়ে মূল্যবান। ১০৭ বছর আগে অ্যান্টার্কটিকার বরফের সাগরে ডুবে যাওয়া জাহাজটির অবশিষ্টাংশের সন্ধান পাওয়া গেছে। যা নিঃসন্দেহে ইতিহাসের সবচেয়ে মূল্যবান জাহাজের অবশিষ্টাংশ। কেননা ইতিমধ্যেই এই জাহাজের কাহিনী লাখো মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে গেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এটি মানুষকে উৎসাহ দিয়েছে এবং আজও দিয়ে যাচ্ছে।