রাশিয়ার ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের জেরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আকাশছোঁয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতির লাগাম টানতে যুক্তরাষ্ট্র দ্বারস্থ হয়েছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। কিন্তু দেশ দুটি যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো পাত্তা দেয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের আশা ছিল, তার অনুরোধে সৌদি ও আমিরাত তেল উৎপাদন বাড়িয়ে এই সংকট মোকাবিলা করবে। কিন্তু তারা এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলতেও রাজি হয়নি।
সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ জায়েদ আল-নাহিয়ান দুজনই বাইডেনের আহ্বান উপেক্ষা করেছেন।
সৌদি-আমিরাতের দ্বারস্থে কেন যুক্তরাষ্ট্র
তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের নেতৃত্ব থাকা সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ব্যাপক তেল উৎপাদন করে। যে কোনো সংকটে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে তাদের। তেলের দাম সহনীয় থাকবে নাকি রেকর্ড মাত্রায় ছাড়িয়ে যাবে তা তারাই ঠিক করতে পারে। করোনা মহামারির মধ্যেও সৌদি আরব তেলের জোগান বাড়িয়ে দিয়ে বিশ্ববাজার প্লাবিত করে দিয়েছিল। সে সময় রাশিয়া ওপেক প্লাস চুক্তিতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাখ্যাত হওয়া কেন
২০১৯ সালে সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় তেল স্থাপনায় ইরান হামলা চালিয়েছিল। সেই হামলার কারণে সৌদির তেল উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ওই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং সে সময় ট্রাম্প সরকার সৌদির অক্ষমতা নিয়ে তিরস্কার করে।
এ ছাড়া ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। ক্ষমতায় আসার পর সৌদি যুবরাজ সালমানের সঙ্গে কথাও বলেননি বাইডেন।
২০১৮ সালে কলাম লেখক ও সৌদি শাসনের সমালোচক জামাল খাসোগি হত্যাসহ যুক্তরাষ্ট্র সালমানকে দোষারোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া যুবরাজের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও করে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদির দূরত্ব কেবল সাম্প্রতিক ঘটনার কারণে নয়। ২০০১ সালে টুইট টাওয়ারে হামলার পর দু’দেশের সম্পর্কের তিক্ততা শুরু হতে থাকে। এরপর ২০০৩ সালে ইরাকে হামলার বিরোধিতা করে সৌদি। বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সেই সম্পর্কের আরও অবনতি হয়। ওবামা ‘মধ্যপ্রাচ্য’ ছেড়ে এশিয়ার দিকে মনোযোগী হয়। এরপর ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘পারমাণবিক চুক্তি’ ভালোভাবে নেয়নি সৌদি।
বর্তমানে ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদির সবচেয়ে বড় মিত্র হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নীরব অবস্থানে ক্ষুব্ধ আমিরাতও। সেই কারণে তেল সংকট মোকাবিলায় বাইডেন প্রশাসনকে সাড়া দেয়নি তারা।
গত নভেম্বরেও বাইডেন প্রশাসন সৌদি আরবকে তেল উৎপাদন বাড়িয়ে বিশ্ববাজারে দাম কমিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল। সৌদি সরকার তখনও যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিল, এবারও ঠিক একইভাবে তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করল।
সৌদির ভরসাস্থল কোথায়
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিতে সৌদি আরব শুধু রাশিয়ার কাছেই আশ্রয় পেয়েছে, তা নয়। প্রশ্রয় পেয়েছে চীন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের কাছেও। দেশগুলোর সঙ্গে সৌদির এখন নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
দুদিন আগেও সৌদি যুবরাজের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। মূলত তেলের বাজার নিয়ে কথা বলেছেন তারা। সৌদি এখন কিছুতেই চায় না, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ নিয়ে রাশিয়া ও চীন থেকে ছিটকে পড়ুক। এর মধ্যে রিয়াদ ইঙ্গিত দিয়েছে, বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুতে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সৌদি ভ্রমণে আসবেন। এ ছাড়া মার্কিন ডলারের পরিবর্তে চীনা ইউয়ানেও তেল বিক্রির কথা চলমান রয়েছে রিয়াদ-বেইজিংয়ের। যদি ইউয়ানে তেল বিক্রি হয়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ডলার সংকটে পড়বে, আর চীনা মুদ্রার স্ট্যাটাস বাড়বে। এ ছাড়া অর্ধশতাব্দী ধরে বৈশ্বিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক ‘পেট্রোডলার’ ব্যবস্থাকে ঝুঁকিতে পড়বে।
ভেনেজুয়েলার দ্বারেও যুক্তরাষ্ট্র
রাশিয়ার মিত্রদেশ ভেনেজুয়েলার কাছেও তেলের জন্য শরণাপন্ন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কথাও জানান মার্কিন কর্মকর্তারা। সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকেই তেল দিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে বলে জানান তারা। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন কয়েকজন আইনপ্রণেতা।
ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্লাসেনসিয়া বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভেনেজুয়েলা আগেও তেল বিক্রি করত। এখন যদি আবার শুরু করে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটা সবার জন্যে ‘মঙ্গলজনক’ হবে।
২০১৯ সালে ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি বন্ধ করা হয়। সে সময় ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।
ভেনেজুয়েলা একসময়ে দিনে ৩০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদন করত। আর এখন উৎপাদন করছে মাত্র ১০ ব্যারেল। তেলের উৎপাদন বাড়াতে ভেনেজুয়েলায় প্রচুর বিনিয়োগ ও সময় প্রয়োজন। আপাতত বাজার স্থিতিশীল রাখার ক্ষমতা দেশটির নেই। রাশিয়া প্রতিদিন বিশ্ববাজারে যে ২৫ লাখ ব্যারেল তেলের জোগান দিয়ে আসছিল, তা ভেনেজুয়েলার পক্ষে আপাতত কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব না।
ইরানের কাছেও ধরনা যুক্তরাষ্ট্রের
তেলের বিকল্প বাজার খুঁজতে ইরানের কাছেও দ্বারস্থ হয়েছেন বাইডেন। রাশিয়াকে একঘরে করতে ইরানকেও পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না হলেও দেশটিকে পাশে যায় তারা। ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালের আন্তর্জাতিক পরমাণু চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ইরানের ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তারা। এই দ্বন্দ্বের মধ্যেও তেহরান থেকে তেল আনতে উৎসাহী ওয়াশিংটন। সেক্ষেত্রে তেলের চাহিদা মেটাতে ইরানেরও সক্ষমতা কম। দেশটির তেল ক্ষেত্র ও উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতেও বিনিয়োগ প্রয়োজন। এটিও সময়সাপেক্ষ।
যুক্তরাষ্ট্র এখন কী করবে
যুক্তরাষ্ট্রের তেলের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা কানাডা। প্রতিবেশী এই দেশটি থেকে যুক্তরাষ্ট্র আমদানির ৫১ শতাংশের বেশি তেল সরবরাহ করে। এরপরই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান তেল সরবরাহকারী মেক্সিকো ও সৌদি আরব। এনার্জি ইনফরমেশন এজেন্সির তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র গত বছর রাশিয়া থেকে প্রতিদিন প্রায় ছয় লাখ ৭২ হাজার ব্যারেল ক্রুড (অপরিশোধিত তেল) ও পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি করেছে। শুধু জ্বালানি তেলের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের মোট আমদানির তিন শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে, যা দৈনিক প্রায় দুই লাখ ব্যারেল।
ভেনেজুয়েলা ও ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানিতে বিরোধী আইনপ্রণেতাদের দাবি, ভেনেজুয়েলা ও ইরান থেকে তেল না কিনে বরং প্রতিবেশীদের সঙ্গে কাজ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। সেক্ষেত্রে কানাডা ও মেক্সিকো গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হতে পারে। ইরান-ভেনেজুয়েলা ও সৌদির মতো অনেক দেশে এখন সে সুযোগ নেই।