বন ও বনভূমির নিরাপত্তা রক্ষার্থে ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় ২১ মার্চকে আন্তর্জাতিক বন দিবস ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে ২১ মার্চকে আন্তর্জাতিক বন দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ‘বন এবং টেকসই উৎপাদন ও ব্যবহার’ থিমে পালিত হচ্ছে এবারের আন্তর্জাতিক বন দিবস।
জলবায়ু পরিবর্তনের অশনি বিপদ থেকে রক্ষা করতে বনের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গাছ থাকলে নিরাপদ পরিবেশ থাকে। বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনগুলি পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে চিন্তাভাবনা করছে। এমতাবস্থায় গাছ লাগানো, বন-জঙ্গল বৃদ্ধি আমাদের পৃথিবী ও তার উপর বসবাসকারী প্রাণীর জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অক্সিজেন বৃদ্ধির পাশাপাশি সবুজ বন পরিবেশের ভারসাম্যও বজায় রাখে।
সব ধরনের বনের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতেই এই দিনে, দেশগুলিকে বন এবং বৃক্ষ সম্পর্কিত কার্যক্রম সংগঠিত করার জন্য স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করতে উৎসাহিত করা হয়। এই কর্মকান্ডের মধ্যে বৃক্ষরোপন অভিযানও অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
১৯৭১ সালে, ইউরোপীয় কনফেডারেশন অফ এগ্রিকালচারের ২৩ তম সাধারণ পরিষদে বিশ্ব বনায়ন দিবস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা গাছের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১২ সালের ২৮শে নভেম্বর, আন্তর্জাতিক বন দিবস প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দুটি আন্তর্জাতিক স্মারক যেমন বিশ্ব বন দিবস এবং আন্তর্জাতিক বন দিবসকে একত্রিত করে প্রতি বছর ২১শে মার্চ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।
বন রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে বন ভবনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশের বন বিভাগের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বন আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট ভূমির ১২ দশমিক ৮ শতাংশ। এর আগে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী যা ছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। এই হিসাবে বনের বাইরের গাছ আমলে নেওয়া হয়নি। কিন্তু বন বিভাগের নতুন সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বনের বাইরে গাছের পরিমাণ মোট ভূমির ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এসব গাছের বেশির ভাগই বেড়ে উঠেছে মূলত সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে। সেই হিসাবে বনের ভেতর ও বাইরে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট ভূমির সাড়ে ২২ শতাংশ।
গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের মতে, পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বনভূমি। একটি বনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ গাছ থাকে। একজন মানুষের শ্বাস নিতে বছরে ৭৪০ কেজি অক্সিজেন প্রয়োজন। গড়ে, একটি গাছ বছরে ১০০ কেজি পর্যন্ত অক্সিজেন দেয়।
২০১৫ সালে নেচার জার্নালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, মানুষ যখন থেকে গাছ কাটা শুরু করেছে, এখন পর্যন্ত ৪৬ শতাংশ গাছ কাটা হয়েছে। বিশ্বে বর্তমানে ৩.০৪ লাখ কোটি গাছ রয়েছে।
ট্রপিক্যাল ফরেস্ট অ্যালায়েন্স ২০২০ অনুসারে, আমরা যদি কোনো পরিবর্তন না করি, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭ লাখ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে বিস্তৃত গ্রীষ্মমন্ডলীয় বন শেষ হয়ে যাবে।
সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, যদি এই হারে গাছ-গাছালি মারা যেতে থাকে, তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতের আয়তনের সমান বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাবে। যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি!
২০০০ এরও বেশি আদিবাসী সংস্কৃতিসহ প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মানুষ তাদের জীবিকা, ওষুধ, জ্বালানী, খাদ্য এবং আশ্রয়ের জন্য বনের উপর নির্ভর করে।
দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন জঙ্গল পৃথিবীর বৃহত্তম বন। যা বিশ্বের ২০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপন্ন করে। নয়টি দেশের সাথে এর সীমানা ভাগ করে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্রাজিল, বলিভিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফ্রেঞ্চ গুয়ানা। এই বনের ৬০ শতাংশই ব্রাজিলে অবস্থিত। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা এই যে, বিশ্বের জন্য আশীর্বাদ এই আমাজন বন প্রতি বছর আগুনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে, কিছু দাবানল এতটাই মারাত্মক ছিল যে বেশ কয়েকদিন ধরেই আমাজন বনে ধোঁয়া উঠছিল। এ ব্যাপারে ব্রাজিল সরকারের করা প্রচেষ্টাও অপ্রতুল।
বন আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষ এবং বিভিন্ন আদিবাসী সংস্কৃতি তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য বনের উপর নির্ভরশীল। প্রাণী এবং পোকামাকড়কে আশ্রয় দেওয়া, বাতাসে অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং আর্দ্রতার ভারসাম্য বজায় রাখা, নদীতে মিষ্টি পানি সরবরাহকারী জলাশয়গুলিকে রক্ষা করতে বনের গুরুত্ব অপরিসীম।
পৃথিবীতে জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখতে, স্থানীয় জলবায়ুকে উন্নত করতে, অক্সিজেন সরবরাহ করতে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড সঞ্চয় করতে, পর্যটন তৈরি করতে, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে, রোগ থেকে আমাদের প্রতিরোধ করতে, মানুষকে সামাজিকতার জন্য জায়গা প্রদান করতে আমাদের বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে।