গ্যাস কিনতে ডলার কিংবা ইউরো নয়, বিনিময়ের মাধ্যম হবে রুবল–পুতিনের এমন ঘোষণার পর আরেকবার নড়েচড়ে বসেছে পশ্চিমা দেশগুলো। রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে ইউরোপের গ্যাস আমদানির নতুন চুক্তির ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়াও ইউরোপ হাতে নিয়েছে তাদের ‘ভিশন ২০৩০’।
তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী দেশ হচ্ছে রাশিয়া। কিন্তু চলতি বছর ফেব্রুয়ারির শেষার্ধে ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান কেন্দ্র করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যে এক বিশাল ভাটা পড়ে।
নিষেধাজ্ঞা আর পাল্টা নিষেধাজ্ঞায় জরাজীর্ণ অবস্থা রাশিয়া-ইউরোপের। এর মধ্যে রাশিয়ার সম্পদ জব্দ করা ও সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর লেনদেন বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত রুশ অর্থনীতিতে বিশাল নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তবে এবার রাশিয়াও এক রকমের নিষেধাজ্ঞাই চাপিয়ে দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর। রাশিয়া থেকে গ্যাস ও জ্বালানি তেল কিনতে হলে ডলার ও ইউরো ব্যবহার করতে পারবে না যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের ইতোমধ্যে করা চুক্তি চালিয়ে যেতে চাইলে গ্যাস ও জ্বালানি তেল কিনতে হবে রাশিয়ান মুদ্রা রুবলের মাধ্যমে।
বুধবার (২৩ মার্চ) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দেওয়া এমন ঘোষণার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজেদের মধ্যকার এই চুক্তির ঘোষণা দিয়েছে।
শুক্রবার (২৫ মার্চ) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরকালে এ ঘোষণা দেন। ঘোষণাকৃত চুক্তি অনুযায়ী, চলতি বছরের শেষার্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়নে ১৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার এলএনজি রফতানি করবে।
বর্তমানে ইউরোপের ৪০ শতাংশ গ্যাসের আমদানি পুরোপুরি রাশিয়ানির্ভর। এক দিনে এই নির্ভরতা কমানো একেবারেই অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০৩০ সাল লক্ষ্যমাত্রা ধরে তাদের এলএনজির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাশিয়ার বিকল্প হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রতিবছর ৫০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস আমদানির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের করা একটি প্রশ্নের জবাবে জো বাইডেন বলেন, ‘রাশিয়া তাদের সম্পদ পুঁজি করে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। পুতিন তার জ্বালানি তেল ও গ্যাস বিক্রির টাকা দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।’
চুক্তির ব্যাপারে বাইডেন বলেন, ‘আমাদের স্বল্প মেয়াদের কষ্ট দীর্ঘমেয়াদি সুফল বয়ে নিয়ে আসবে। আমি জানি, রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি করতে না পারলে গ্যাসের দাম বেড়ে যাবে, বেড়ে যাবে আমদানি খরচ। কিন্তু বাস্তবিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে রাশিয়াকে আর সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না।’
ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন দেয়ার লিয়েন বলেন, ‘আমরা ইউরোপিয়ানরা রাশিয়া থেকে আমাদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে চাই। আমরা এমন কারো ওপর নির্ভর করতে চাই যে বিশ্বাসযোগ্য। এ ক্ষেত্রে আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে আমাদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছি।’
চুক্তিটি বাস্তবায়ন হলে রাশিয়ার ওপর থেকে এক-তৃতীয়াংশ নির্ভরশীলতা কমে আসবে বলে জানান লিয়েন।
এ ছাড়াও হোয়াইট হাউসের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তি যেমন থার্মোস্টাট ও হিট পাম্প ব্যবহার করে ইউরোপ নিজেরাই গ্যাস উৎপন্ন করতে পারবে। এতে রাশিয়া থেকে বাধ্যতামূলক গ্যাস কেনার প্রবণতা অনেকাংশে কমে আসবে।
একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, ঘরে ঘরে ‘এনার্জি সেভিং’-এর মাধ্যমে চলতি বছরেই সাড়ে ১৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার এনার্জি গ্যাস সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া পরবর্তী সময়ে সৌরশক্তি ও উইন্ড মিল ব্যবহার করে ২০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার এলএনজি ইউরোপ নিজেরাই উৎপাদন করতে পারবে।
২০৩০ সালের মধ্যে এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ও গ্যাস ব্যবহারে সাশ্রয়ী হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৭০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার অবধি গ্যাস সংরক্ষণ করতে পারবে বলে আশা করছে সংস্থাটি। এদিকে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার অতিরিক্ত গ্যাস আমদানি করা গেলে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা সিংহভাগ কমে আসবে বলে আশা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।