আরব বসন্তের সময় তিউনিসিয়া, মিশর, লেবানন থেকে শুরু করে সিরিয়ায় পর্যন্ত রাজপথে নামা মানুষ গণতন্ত্র ও ন্যায় বিচারের পাশাপাশি স্লোগান দিয়েছিল রুটির জন্য।
আরব বসন্তের এক দশক পেরিয়ে গেলেও পরিস্থিতি প্রায় একই রকম রয়ে গেছে। আবারও বিশ্বের দেশে দেশে কড়া নাড়ছে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, করোনা মহামারির কারণে খাদ্যপণ্যের দাম রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তার ওপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে হুমকিতে পড়েছে পুরো বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা।
আফ্রিকা থেকে এশিয়া, লাতিন আমেরিকা থেকে ইউরোপের দেশে দেশে সরকারের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে এ খাদ্যপণ্যের নাটকীয় মূলবৃদ্ধি।
শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও পেরুর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এ বিষয়গুলোই ফুটে উঠছে।
পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে ইমরান খান সরকারের পতন ঘটানো এতটা সহজ ছিল না, যদি না দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ তার সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ না হত।
দ্রব্যমূল্যে বৃদ্ধি পাওয়ায় পেরুতে শুরু হয়েছে সহিংস বিক্ষোভ। এতে অন্তত ৫ জন মারা গেছেন।
২০১১ সালের আরব বসন্তের সময়েও খাদ্যের দাম রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার খাদ্যমূল্য সূচক ২০১০ সালের ১০৬ পয়েন্ট থেকে ২০১১ সালে ১৩৯ পয়েন্টে উঠে গিয়েছিল। আরব দেশগুলোতে সে সময়ের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পেছনে বড় ধরনের প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল এ খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধিও।
ঠিক এক দশক পরেও একই ধরনের ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতেও খাদ্যের দাম রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে গেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রকাশিত খাদ্য মূল্য সূচক এ বছরের মার্চ মাসে ১৫৯ দশমিক ৩ পয়েন্টে পৌঁছেছে। যা গত ফেব্রুয়ারি মাসের থেকে প্রায় ১৩ শতাংশ বেশি।
ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যেকার যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আরও বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের দাম ও সরবরাহ অবনতি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সামনের মাসগুলোতে বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দাম আরও বৃদ্ধির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
যুদ্ধাক্রান্ত ইউক্রেনের রফতানি হওয়া গমের ৪০ শতাংশই যায় মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার খাদ্য সংকটে আক্রান্ত দেশগুলোয়। ইউক্রেনের যুদ্ধের ঘটনাবলী সেখানে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এতে করে দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে গম ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের দাম বাড়ার পাশাপাশি মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যোগ হয়েছে তেলের বাড়তি দাম। করোনা মহামারির পর বিশ্বজুড়ে চাহিদা বৃদ্ধি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলোতে। এ দেশগুলো ব্যাপকভাবে খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল। তাদের আমদানির প্রধান উৎস ইউক্রেন ও রাশিয়া।
এ দেশগুলোর সরকার খাদ্যপণ্যের ওপর ব্যাপক ভর্তুকি দিয়ে থাকে। কিন্তু জ্বালানির দামের অব্যাহত বৃদ্ধি ও একই সঙ্গে খাদ্যের দামের বৃদ্ধির ফলে ভর্তুকি বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে সংশ্লিষ্ট সরকার।
আফ্রিকার দেশগুলোতে ইতোমধ্যেই খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে। বিশ্বের ৭০ ভাগ দরিদ্র লোক থাকে এ মহাদেশে। বিশেষ করে ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং বুরকিনা ফাসোর মতো দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে।
এমনকি খাদ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রকোপ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না ইউরোপের মতো উন্নত অর্থনীতির মহাদেশও।
মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ন্যূনতম বেতনের সীমা বাড়ানোর দাবিতে গ্রিসের রাজপথে বিক্ষোভ করেছেন হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির কারণে ইউরোপে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। এদিকে মারি লে পেনের মতো উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের জনপ্রিয়তা বাড়াছে।
ফ্রান্সের আসন্ন নির্বাচনেও এবারের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যের দাম। ইতোমধ্যেই মূল্যস্ফীতিতে ভুগতে থাকা দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জন্য স্বল্পমূল্যের রেশন কার্ডের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মারি লে পেন। হাঙ্গেরিতেও সম্প্রতি হয়ে যাওয়া নির্বাচনে জয়লাভ করেছে ভিক্টর ওরবানের মতোন ডানপন্থি রাজনীতিক।