ইউক্রেন ইস্যুতে গত মার্চের শেষ দিকে ভারতের অবস্থান জানতে দেশটিতে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া। তবুও ভারত অটলভাবে নিরপেক্ষ থেকেছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ইউক্রেনে রুশ অভিযানের নিন্দা জানাতে এখন পর্যন্ত ভোট দেয়নি ভারত।
মার্কিন উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা দলীপ সিং গত ৩০ ও ৩১ মার্চ নয়াদিল্লি সফর করেছিলেন। সে সময় তিনি রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা কাটানোর ব্যাপারে অন্য দেশের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, রাশিয়া থেকে জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্য ভারত আমদানি করুক তা যুক্তরাষ্ট্র চায় না।
এর এক সপ্তাহ পরে গত ৬ এপ্রিল হোয়াইট হাউসের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের পরিচালক ব্রায়ান ডিজ ঘোষণা করেন, মস্কোর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের পরিণতি ভারতের জন্য অর্থযুক্ত ও দীর্ঘমেয়াদি হবে।
বিশ্বের বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারত। এ শতাব্দির শুরু থেকে দেশটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে সুসস্পর্ক বজায় রেখে আসছে। বাইডেন প্রশাসনও ভারতের ঐতিহ্য ও আমেরিকায় ভারতীয় সম্প্রদায়ের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন নিঃসন্দেহে আশাবাদী ছিল, ভারত রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞা মেনে চলবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বার্ষিক সামরিক মহড়া ছাড়াও ভারত চতুর্মুখী নিরাপত্তা সংলাপের (কোয়াড) অংশ। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রসহ কোয়াডে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও জাপানও। চার-দেশীয় এ অংশীদারিত্ব ২০০০-এর দশকে গঠন করা হয়েছিল। এর মূল লক্ষ্য হলো চীনের উত্থান ঠেকানো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামরিক মহড়াও বাড়িয়েছে কোয়াড।
কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা জানাতে ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ বজায় রেখেছেন। বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর আমেরিকার সঙ্গে সংযোগ, চীনকে নিয়ন্ত্রণ, রাশিয়াকে আশ্বস্ত, জাপানের সঙ্গে মত্ত ও ইউরোপের সঙ্গে খাতির জমানোর নীতির কথা জানিয়েছিলেন।
ভারতের সতর্ক অবস্থানকে পুঁজি করে রাশিয়া
এ ছাড়াও গত কয়েক শতাব্দী ধরে পশ্চিমাদের সঙ্গে ভারতের তিক্ত ইতিহাস রয়েছে। ১৪৯৮ সালে কালিকটে ভাস্কো দা গামার পতনের পর ইউরোপীয় শক্তিগুলো (পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি ও ব্রিটিশ) ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করতে চেয়েছিল। এটি পরে ঔপনিবেশিকতায় রুপ নিয়েছিল। সেইসঙ্গে ডাচ ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ার মাধ্যমে ভারতবর্ষে শোষণ করা হয়েছিল।
ভারত ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের সময় ভারত ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমের মধ্যে সম্পর্ক জটিল ছিল। ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় উত্তেজনা যখন চরমে ওঠে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সমর্থনে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল।
এ ছাড়া আফগানিস্তানে ২০ বছরের যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে অব্যাহত সমর্থন ও সহযোগিতা করেছিল। পাশাপাশি ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান উভয়েরই পারমাণবিক পরীক্ষার জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা – এসব ঘটনা সাম্প্রতিক দশকে নয়াদিল্লিকে বিরক্ত করেছে। এই অঞ্চলে ইউরোপের ইতিহাস থাকায় নয়াদিল্লি তার বিদেশ নীতির বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়া থেকে সতর্ক রয়েছে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় এর বিপরীতে ভারত ও রাশিয়ার ইতিবাচক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ভারত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) অন্যতম নেতা হওয়া সত্ত্বেও মস্কো ও নয়াদিল্লির মধ্যে সম্পর্ক বিকশিত হয়েছে। ১৯৭১ সালের আগস্টে ইন্দো-সোভিয়েত শান্তি, বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে তাদের অংশীদারিত্ব আনুষ্ঠানিক রূপ নেয়।
১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে কয়েক মাস পর বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহর ঠেকাতে সোভিয়েত প্যাসিফিক ফ্লিটের (রুশ নৌবহর) উপস্থিতি দেখা যায়। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে অস্ত্রের চালান প্রদান করে, এমনকি ভারতের মহাকাশ কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এর পর দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা সম্পর্কের আলোকে ১৯৮৭ সালে সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা (আইএলটিপি) চুক্তি সম্পন্ন হয়।
ক্রেমলিনের সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্কে ভাটা পড়ায় এ অংশীদারিত্ব লালনে মস্কো নতুন করে তৎপর হয়েছে এবং প্রধান শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হয়েছে।
নির্ভরযোগ্য প্রতিরক্ষা অংশীদার
বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ ভারত। অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের জন্য ভারতের বাজার গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের শীর্ষ সরবরাহকারী দেশ এ রাশিয়া। একুশ শতকে রাশিয়ার বাণিজ্য বেড়েছে। কারণ ভারতের অর্থনীতি বেড়েছে। তবে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে ঐতিহ্যগত বিরোধের কারণে উদ্বিগ্ন ভারত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের অস্ত্রের বাজারে রাশিয়ার আধিপত্য কমেছে। কিন্তু ভারতের অস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণ ও হালনাগাদ, খুচড়া যন্ত্রাংশ আমদানি ও রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রয়োজন রয়েছে। এ সম্পর্ক থাকা মানে হলো সামরিকভাবে রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের আবদ্ধ থাকা। গত ডিসেম্বরে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদি স্বাক্ষরিত ১০ বছরের প্রতিরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে এ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়েছে।
ভারত বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে রাশিয়ার সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে সক্ষম হয়েছে। মস্কো ঐতিহাসিকভাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে ভারতের পক্ষে ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করেছিল। ভারতও চীনের সঙ্গে রাশিয়ার মধ্যপন্থী প্রভাব আছে বলে মনে করে।
এসব কারণে ইউক্রেন অভিযানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভেটো প্রদান করেনি ভারত এবং ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশ ট্যাগে আই স্ট্যান্ড উইথ পুতিন (আমি পুতিনের পক্ষে) ক্যাম্পেইন দেখা গিয়েছিল।
রাশিয়া ও ভারত সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জ্বালানি সম্পর্ক সম্প্রসারণের পদক্ষেপ নিয়েছে। চলতি বছরের গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ান অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে ভারত রাশিয়া থেকে ১৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল কিনেছে। ২০২১ সালের পুরো বছরে যার পরিমাণ ছিল ১৬ মিলিয়নের কম।
ভারতকে কয়লাও সরবরাহ করে রাশিয়া। গত বছর থেকে ২০ বছরের চুক্তিতে রাশিয়ার তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসও (এলএনজি) আমদানি শুরু করে ভারত। এ বছরের জানুয়ারিতে রাশিয়ার রাষ্ট্রচালিত পারমাণবিক শক্তি সংস্থা রোসাটম ভারতে ষষ্ঠ পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ শুরু করেছে।
ভারত ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নের মধ্যে একটি সম্ভাব্য মুক্ত-বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমাতে দুই দেশ রুপি-রুবল পেমেন্ট সিস্টেমের পরিকল্পনা করছে।