বরিশাল: বরিশাল নগরের কাশীপুর বাজারে তিনজন মাছ বিক্রেতা প্রতিদিন ৪-৫ ইঞ্চি আকারের জাটকা (ইলিশের বাচ্চা) প্রতি কেজি দেড়শ থেকে দুইশ টাকায় বিক্রি করেন।
এক কেজিতে ৫০-৬০ পিস মাছ পাওয়া যায়। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরিশালে মাছের অন্যতম পাইকারি মোকাম বাবুগঞ্জে উপজেলার মীরগঞ্জ থেকে পাইকারি কেনেন তারা।
মীরগঞ্জের মতো বরিশাল নগরের পোর্ট রোড, তালতলী বাজার, লাহারহাটসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন শত শত মণ ২-৩ ইঞ্চি সাইজের জাটকা পাইকারি বেচাকেনা হয়।
খুচরা বিক্রেতারা প্রকাশ্যে নগরের সবগুলো বাজার এবং অলিগলিতে ফেরি করে ‘চাপিলা’ নামে বিক্রি করেন। এ ছাড়া প্রতিদিন দক্ষিণাঞ্চলের নদনদীতে নিধন করা শত শত মণ কথিত ‘চাপিলা’ নৌ ও সড়কপথে সারাদেশে বাজারতজাত হচ্ছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের আইনে ১০ ইঞ্চির কম আকারের ইলিশ আহরণ, ক্রয়-বিক্রয় এবং পরিবহন নিষিদ্ধ। নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীকে সর্বোচ্চ ১ বছরেরর জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে।
নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ডের সহযোগিতায় মৎস্য অধিদপ্তর আইনটি কার্যকর করবে। তবে সব আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ২-৩ ইঞ্চি সাইজের জাটকা নিধন, পরিবহন এবং ক্রয়-বিক্রয় দক্ষিণাঞ্চলে ওপেন সিক্রেট বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে।
বরিশালের মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস বলেন, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় প্রজনন মৌসুমে নদনদীতে প্রচুর ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে। যে কারণে এবার ইলিশের সঙ্গে বাচ্চাও বেশি ধরা পড়ছে। এগুলো নিধন ও বিক্রি বন্ধে মৎস্য অধিদপ্তর প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছে।
সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, নদীতে আহরণ থেকে শুরু করে বাজারে খুচরা বিক্রি সবকিছুই চলছে মৎস্য প্রশাসনকে ম্যানেজ করে। বরিশাল নগর আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতা মাছ ব্যবসায়ী পুরো দক্ষিণাঞ্চলে মৎস্য সিন্ডিকেটের মূল নেপথ্যে শক্তি বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
প্রতিদিনের বাজার বা পাইকার মোকামে মাছ ব্যবসায়ীদের মধ্যেই নির্ধারিত এজেন্টের মাধ্যমে মাসোহারা পান দায়িত্বরত মৎস্য কর্মকর্তারা। মাসোহারায় অনিয়ম হলেই লোক দেখানো অভিযান হয়।
অন্যদিকে নদনদীতে জাটকা নিধনে জেলেদের পেছনে রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট। রয়েছে কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ ও রাজনৈতিক ছত্রছায়া।
যারা স্থানীয়ভাবে ঘাটমহাজন বা আড়তদার নামে পরিচিত। সেখানকার পরিস্থিতি এমনটাই যে- প্রভাবশালীদের পূর্ব অনুমাতি ছাড়া প্রশাসন নদীতে অভিযানে গেলে জেলেদের হামলার শিকার হতে হয়।
সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, দক্ষিণাঞ্চলে কথিত চাপিলা ক্রয়-বিক্রয়ের সবচেয়ে বড় মোকাম বরিশাল নগরীর পোর্ট রোড ইলিশ মোকাম, সদর উপজেলার তালতলী, বাবুগঞ্জ উপজেলার মীরগঞ্জ, পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি ও বাদামতলী লঞ্চঘাট।
বরিশালের হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ সংলগ্ন মেঘনায় নিধন করা ইলিশের বাচ্চা বরিশালের মোকামে এবং ভোলার মেঘনা-তেঁতুুলিয়া নদীরটা গলাচিপার পানপট্টি লঞ্চঘাট ও বাদামতলী লঞ্চঘাটে পাইকারি বিক্রি হয়।
সূত্র জানায়, মেঘনার ভোলার ইলিশা পয়েন্ট থেকে শুরু করে বরিশালে হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ হয়ে চাঁদপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ মেঘনা এবং মেঘনার শাখা তেঁতুলিয়া, কালাবদর, আড়িয়াল খাঁ নদী জাটকার সবচেয়ে বড় বিচরণ ক্ষেত্র।
এ নদনদীতে ২-৩ ইঞ্চি ইলিশের বাচ্চা নিধনের মহোৎসব চলছে। গলাচিপা থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে তিনটি ট্রাকবোঝাই কথিত চাপিলা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয় বলে স্থানীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ এবং ভোলার চরফ্যাসন ও তজুমউদ্দিন মেঘনা তীরবর্তী বিভিন্ন মাছঘাট থেকে যাত্রীবাহী লঞ্চ ও ট্রলারে ইলিশের বাচ্চা পাঠানো হয় রাজধানীতে।
হিজলার ধুলখোলা ইউনিয়ন জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনির মাতুব্বর জানান, নিষেধাজ্ঞার দুই মাসে মেঘনায় মাছ আহরণের জন্য প্রশাসনের সঙ্গে তিন লাখ টাকার দফারফা করেছেন প্রভাবশালী মাছঘাট মালিকরা। দুই উপজেলার মেঘনা তীরে অর্ধশতাধিক মাছঘাটে জাটকা ক্রয়-বিক্রয়ের জমজমাট ব্যবসা চলছে।
প্রভাবশালীদের মাছঘাটে জাটকার পাইকারি ক্রয়-বিক্রয় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হিজলা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এমএম পারভেজ বলেন, আমরা তাদের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না, নৌ পুলিশ চলে তাদের ইচ্ছেমতো। কোস্টগার্ড রাতে নামে না, দিনে ২-১ বার অভিযানে নামলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতির অজুহাত দেখিয়ে নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতার মধ্যে থাকেন।
থানা পুলিশের কাছে ফোর্স চাইলে তাৎক্ষণিক দিতে পারেন না। এ মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, আমাদের নিজস্ব জনবল ও জলযান কোনোটাই নেই। জেলা প্রশাসনের কাছে দুই মাসের জন্য একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেট চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু পাইনি। তারপরও সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।
নগর ও সদর উপজেলার হাটবাজার তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সঞ্জীব সন্যামত। নগরের মধ্যে হাটবাজারে ২-৩ ইঞ্চি ইলিশ বাচ্চা কীভাবে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, খুচরা বিক্রেতারা চোরাগোপ্তাভাবে বিক্রি করছেন। সম্প্রতি তালতলী বাজারে অভিযান চালিয়ে ৩৫ মণ এবং লাহারহাটেও বিপুল পরিমাণ জাটকা জব্দ করছেন।
পটুয়াখালীর গলাচিপার বদনাতলী মোকামের ইজারাদার কবির মাস্টার বলেন, ওই মোকামে ছোট ইলিশ বা জাটকা বিক্রি করতে দেওয়া হয় না। তবে ভোলা ও বাউফল থেকে কাচকি মাছ বিক্রি করতে আসা কিছু অসাধু জেলে রাতে গোপনে ছোট ইলিশ বিক্রি করে বলে তিনিও শুনেছেন।