পবিত্র রমজান শুরুর একদিন আগের কথা। নিউইয়র্ক সিটির ব্রুকলিনে একটি ফুড-ব্যাংকে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করছিলেন জাবরান আকরাম। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত মানুষকে তিনি খাবার বিতরণ করেন।
যারা খাবারের আশায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ান, সাধারণত তাদের বড় এক টুকরো রুটি দেওয়া হয়। কিন্তু এদিন যারা এসেছিলেন, তাদের ব্যাগভর্তি খাবার বিলিয়েছেন আকরামরা। কারণ তারা জানতেন, এসব মানুষের বাড়িতে পর্যাপ্ত খাবার নেই। কেবল রুটিতেই তাদের প্রয়োজন মিটবে না।-খবর মিডল ইস্ট আইয়ের
সেদিন খাবারের সারিতে কয়েকশ’ মানুষ দাঁড়িয়েছিলেন। আকরাম বলেন, পরিবারের অভাব সামাল দিতে রেশন ছাড়া এসব মানুষের সামনে আরও কোনো বিকল্প নেই।
ব্যাগ খুলে রুটি বিলাচ্ছিলেন, আর কথা বলছিলেন তিনি। এই দাতব্যকর্মী বলেন, গেল দুবছর ধরে মানুষের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। যা আগে আমরা কখনো দেখিনি। খাদ্যমূল্য বাড়ছে। সেই তুলনায় আয় বাড়েনি। যে কারণে আগের মতো ক্রয় ক্ষমতাও নেই। এতে বিপাকে পড়ে গেছেন লোকজন।
আকরাম বলেন, এই পরিস্থিতির জন্য মুদ্রাস্ফীতি দায়ী। লোকজন যখন মহামারির ঝক্কি কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছেন, তখন তারা মূল্যস্ফীতির কবলে পড়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে জানা গেছে, নিউইয়র্ক ও নিউজার্সিতে ফেব্রুয়ারিতে খাদ্যমূল্য শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ বেড়েছে। আর গেল এক বছরে ওয়াশিংটন ডিসি, ম্যারিল্যান্ড ও ভার্জিনিয়ায় বেড়েছে ছয় দশমিক সাত শতাংশ।
মার্কিন কৃষি অধিদফতর জানিয়েছে, ঘরের বাইরে প্রস্তুত করা খাবারের মূল্যবৃদ্ধি ঐতিহাসিক গড়কে ছাড়িয়ে গেছে।
ওয়াশিংটনের বাইরে ভার্জিনিয়ার উপকণ্ঠের বাসিন্দা স্ট্যাসি পিকার্ডও একই ধরনের সংকটে পড়েছেন। গেল চার বছর ধরে তিনি দার আল-হাজিরা মসজিদের সামাজিক সেবা থেকে সহায়তা নিয়ে আসছেন। প্রতি বৃহস্পতিবার মসজিদটি থেকে অভাবীদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশ স্পর্শ করতে চাচ্ছে। সবকিছু সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে স্বেচ্ছাসেবীরাও বিপাকে পড়ে যান। কারণ কখনো-কখনো তাদের সামর্থ্য কমে আসে। আকাঙ্ক্ষা অনুসারে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন না।
আকরাম বলেন, মাঝে-মাঝে আমাদের ব্যাগের আকার ছোট হয়ে আসে। তখন আমাদের অভিজ্ঞতা মিশ্র হয়ে যায়। কঠিন হিসাব-নিকাশ করে খরচ করতে হয়। সবকিছুর উচ্চমূল্য মাথায় রেখে কম দামের জিনিস কিনতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, এসব ব্যাগ সাধারণত চার ডলারে পাওয়া যায়। কিন্তু তার চেয়ে এক ডলার বাড়িয়েও ছোট ব্যাগ কিনতে হচ্ছে।
১৯৮২ সালের পর সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি আঘাত হেনেছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতির মানদণ্ড নির্ধারণ করে দ্য ফেডারেল রিজার্ভ। তারা বলছে, গত বছরের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি ছয় দশমিক এক শতাংশ বেড়েছে।
মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও কৃষি নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষক হোয়া হোয়াং বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের তাৎক্ষণিক প্রভাবে এভাবে সবকিছুর দাম বেড়েছে।
আরও পড়ুন: যুদ্ধের কারণে বাড়বে খাদ্যমূল্য
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে অনুভব করা যায় না। কিন্তু প্রত্যাহিক জীবনে লোকজন তা হাড়ে-হাড়ে টের পান। খাদ্য অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে লোকজন।
সীমিত আয়ের মানুষ অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দাম বাড়ায় তাদের ক্রয় ক্ষমতা ছোট হয়ে আসছে। হোয়া হোয়াং বলেন, যদিও এতে ধনীদের কিছু হবে না। তাদের খাদ্য তালিকা ও মান আগের মতোই থাকবে। কারণ এতে তাদের ব্যবহারযোগ্য আয়ের ছোট একটা অংশ খাদ্য কেনায় চলে যাবে।
কিন্তু যারা দরিদ্র, খাদ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় তারা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাদের খাদ্যতালিকা ও মানও কমে যাবে। তাদের ব্যবহারযোগ্য আয়ের এক-তৃতীয়াংশ খাবার কিনতে খরচ করতে হবে। মুদি পণ্যে ১০ শতাংশ দাম বাড়লে তাদের কেনাকাটায় ভালোই প্রভাব পড়বে। অস্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে তাদের ঝোঁক চলে যাবে।
গবেষক হোয়া হোয়াং বলেন, অন্য পণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির তফাত আছে। বাসাভাড়া, স্বাস্থ্যসেবা ও লেখাপড়ার খরচ বাড়লে তাতে মানুষের যে প্রভাব পড়ে, খাবারের দাম বাড়ায় সেই প্রভাব অনেক বেশি তীব্র হয়।
তার মতে, সামান্য পুঁজির কাউকে উল্লেখযোগ্য ক্রয় ক্ষমতা ছোট করতে হলে তিনি খাবারে খরচ কমিয়ে দেবেন। সীমিত আয়ে সংসার চালাতে গিয়ে তাদেরকে খাবারের মানের সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে। নিম্নমানের খাবার কিনতে হবে তাদের।
মার্কিন কৃষি অধিদফতরের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরে সব ধরনের খাবারের দাম সাড়ে চার থেকে সাড়ে পাঁচ শতাংশ বেড়ে যাবে। আর পোল্ট্রি খাবারের দাম বাড়বে ছয় থেকে সাত শতাংশ।
এই চাপ অনুভবের কথা বলছিলেন দ্য কাউন্সিল অব পিপলস অর্গানাইজেশনের (সিওপিও) প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ রিজভী। শুক্রবার খাবারের অপেক্ষায় থাকা কয়েকশ’ মানুষের সারির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তার খাদ্যভাণ্ডার বেলা ১১টায় খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু মানুষের লাইন শুরু হয় সকাল ছয়টায়। কেউ কেউ লাইন ভেঙে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তর্কে জড়াচ্ছেন।
মহামারি যখন চরম রূপ নিয়েছিল, তখন সিওপিও তাদের স্থানীয় খাদ্য ভাণ্ডার থেকে মানুষকে সহায়তা করেছে। রিজভী বলেন, এর মধ্য দিয়ে মানুষকে চাপমুক্ত হতে সহায়তা করছি। কোনো এক লাইনে তিন হাজার মানুষও দাঁড়িয়েছিলেন।
এছাড়া স্থানীয় গির্জায়ও তিনি খাদ্য সহায়তা করেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে তা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই দাতব্যকর্মীর ভাষায়, আমরা নিজেরাও খুব বেশি খাবার সংগ্রহ করতে পারছি না। সবাই বলছেন, এতে তারা ভালো থাকছেন। কিন্তু আসলে তা-না। এখনো খাবারের লাইনে মানুষ। তাদের সহায়তা দরকার।
তিনি জানান, নির্দিষ্ট কোনো লোকজনই এই সারিতে আসেন না। চাইনিজ, স্প্যানিশ, রাশিয়ান ও আরবরাও আসেন। সবার সহায়তা দরকার।
২০০৮ সালে আলেক্সান্ডার র্যাপাপোর্ট প্রতিষ্ঠা করেন খাদ্য ব্যাংক মাসবিয়া। তখন সেখানে মুসলমানদের খুব একটা খাদ্য-ব্যাংক ছিল না। মুসলমানরা খাদ্যের জন্য মাসবিয়ার দারস্থ হতেন। কিন্তু পরিস্থিতি কিছুটা বদলে গেছে। তারা খাদ্য ব্যাংক গড়ে তুলেছেন।
রমজানের আগে তাদের স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যাও বাড়ছে। তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে নিয়মিত খাবার বিতরণ করছেন।