পা নেই, তাতে কী? থেমে থাকেন না জিতু রায়। কখনও হাতের তালুতে ভর দিয়ে ছোটাছুটি। কখনও হুইল চেয়ারে বসে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করা। কখনও স্কুটি চালিয়ে এদিক সেদিক যাওয়া-আসা, দূরের যাত্রায় চেপে বসেন নিজের প্রাইভেটকারে।
নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে না পারলেও জিতু রায় নিজের ঘাড়ে ৪৫০ মানুষের জীবন-জীবিকার ভার নিয়েছেন। ৩ বছর বয়সে পোলিও আক্রান্ত হয়ে যাকে মেনে নিতে হয়েছিল পঙ্গুত্বের জীবন, সেই জিতুই আজ একজন সফল উদ্যোক্তা। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা, দরিদ্র আর সমাজের ভ্রুকুটিকে তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে প্রমাণ করেছেন, লক্ষ্যপূরণে কোনোকিছুই বাধা নয়। ফ্রিল্যান্সিং, শিশুদের জন্য বিভিন্ন পণ্য তৈরি ও অনলাইন মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে গড়ে তুলছেন তার প্রতিষ্ঠান। তিনি প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন।
সাফল্যের গল্পের শুরুটা সহজ ছিল না। বাবার কাঁধে চড়ে প্রাথমিকের বৈতরণী পার হলেও মাধ্যমিকের সময় পঙ্গু সন্তানকে আর বইতে পারেননি মহেন্দ্র রায়। মানুষের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর অবহেলায় তবু ভেঙে পড়েননি। দিনমজুর বাবার জমানো অল্প পুঁজিতে ভাঙড়ির ব্যবসা শুরু করলেও শারীরিক সক্ষমতার অভাবে ওই ব্যবসা ধরে রাখতে পারেননি। বাবার কোলে চড়ে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ শিখতে যান। সেখানেও বাধা হয়ে ওঠে পঙ্গুত্ব।
উদীয়মান উদ্যোক্তা জিতু রায় বলেন, যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করি, তখন আমার কারও ঘাড়ে চেপে স্কুলে যেতে হত। আমি সব সময়ই বুঝতাম যে অন্যরা আমাকে অন্য চোখে দেখত। যা আমার খারাপ লাগত। আমি সব সময়ই চিন্তা করতাম, আমাকে এমন কিছু করতে হবে যেন পুরো দেশ আমাকে চেনে। এ চিন্তা ভাবনা আমার ছোট বেলা থেকেই ছিল।
ক্লাস ৮ পাস করার পর আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া হয়নি উল্লেখ করে জিতু বলেন, সেসময় আমার বাবা কিছু টাকা পুঁজি করে ভাঙড়ির ব্যবসা করে দেয়। সেটি ৩ থেকে ৪ বছর করার পর আমি দেখলাম, লোহার যে বিষয়টি রয়েছে, সেটি আমার জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে যায়। সেই সঙ্গে দূরত্বও একটি সমস্যা ছিল। তখন আমি সেটিও বন্ধ করে দেই।
মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ শেখার বিষয়ে জিতু বলেন, তখন বাবাকে বলি যে আমার এমন একটি কাজ করা উচিত যেটি আমরা জন্য সহজ। সেসময় মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কথা শুনি। এটি কলেজ রোডের তিন তলায় শিখানো হত। আমার পক্ষে তো আর তিন তলায় ওঠা সম্ভব না। টানা ছয় মাস আমার বাবা এ বড় অবস্থায় ঘাড়ে কোলে করে নিয়ে আমাকে মোবাইল সার্ভিসিং শিখান। আসলে এটি অনেক কষ্টের ব্যাপার। কারণ এ বয়সে বাবারা আমাদের ঘাড়ে থাকবেন। সারা জীবন মা-বাবারা আমাদের জন্য কষ্ট করেছেন। এ জিনিসগুলো আমায় অনেক তাড়া দিত।
অবশেষে ফ্রি-ল্যান্সার হতে চাইলেন। কিন্তু একটি কম্পিউটার না থাকায় দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। সাহায্য না করে অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও একদিন এগিয়ে আসেন বাল্যবন্ধু তৌহিদ। জিতুকে নিজের কম্পিউটার দেন। পরে একবছরের মধ্যে জিতু ফ্রিলান্সিং আয়ত্ব করেন। পাশাপাশি ১০ থেকে ১২ জনকে শিখতে সহায়তা করেন। এক বছরের মাথায় প্রথমবারের মতো ৫০০ ডলার আয় করেন। সময়টা ছিল ২০১২ সাল। তারপর আর পেছনে তাকাননি জিতু রায়।
ফ্রিলান্সিং শুরু করার বিষয়ে জিতু বলেন, বন্ধুদের মাধ্যমে ফ্রিলান্সিংয়ের বিষয়ে জানতে পারি। কিন্তু আমাদের পরিবারের অবস্থা তো এত ভালো না। এটি করতে কম্পিউটার লাগবে। তখন কাজ শেখার জন্য আমার বন্ধুরা আমাকে তাদের ব্যবহৃত কম্পিউটার দেয়। টানা ২ থেকে ৩ বছর দিনরাত শুধু গুগল ও ইউটিউব দেখে দেখে আমি অ্যাফ্লিয়েটেড মার্কেটিং শিখি। আমি ধীরে ধীরে আমার দলে আরও মানুষ যোগ করতে থাকি।
তিনি আরও বলেন, এক সময় আমার ফ্রিলান্সিং ক্যারিয়ারে ২০ থেকে ৪০ জন সদস্য হয়ে যায়। ৩০০ ডলার থেকে শুরু করে এমনও মাস গেছে যখন আমার ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার ডলার পর্যন্ত আয় হয়েছে। পরে আমার নতুন কাছের প্রতি আগ্রহ থাকায় আমি এসইও নিয়েও কাজ শুরু করি।
পরে শুধু এসইও নিয়েই কাজ করার কথা জানিয়ে জিতু বলেন, আমার দলের অন্যান্যরা এখন আলাদা আলাদাভাবে কাজ করছেন এবং ভালো কাজ করছেন। এটি আমার বেশ ভালো লাগে।
প্রথম সন্তানের জন্মের সময় কিছু বেবি প্রোডাক্ট কিনতে গিয়ে এসবের মান ও চায়না প্রোডাক্টের আধিপত্য দেখতে পান জিতু। তার অনলাইন মার্কেটিং সম্পর্কেও ধারণা ছিল। এসব অভিজ্ঞতা থেকে রকমারি শিশু ঘর ডট কম নামে ওয়েবসাইট খুলে শিশুদের বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে অনলাইনে বিক্রি করে প্রতিমাসে আয় করছেন কয়েক লাখ টাকা।
জিতুর প্রতিষ্ঠানের জন্য ৪০০ এরও বেশি নারী বাড়িতে বসেই শিশুদের কাঁথা, বালিশ, মশারিসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করেন। সেসব পণ্যের অনলাইন মার্কেটিং করছেন ৫০ জন তরুণ-তরুণী।
তার প্রতিষ্ঠানে পার্ট টাইম চাকরি করছেন অনেক শিক্ষার্থী। তারা জানান, পড়াশোনার পাশাপাশি আমরা এখানে কাজ করছি। এতে আমরা নিজের খরচ নিজেই চালাতে পারছি। সেই সঙ্গে পরিবারকেও সাহায্য করতে পারছি। এতে আমরা বেশ খুশি।
জিতুর প্রতিষ্ঠানে কাজ করা একজন নারী কর্মী বলেন, আমি বাসায় বেকার ছিলাম। আমি এখান থেকে বেতন দিয়ে নিজেদের চাহিদা পূরণ করতে পারছি। আমার বাসার আশেপাশে অনেক বেকার লোক ছিল। এখান থেকে কাঁথা নিয়ে যেয়ে আমি তাদের দিয়েছি। তারা আমার তত্ত্বাবধানে বাসায় বসে কাজ করে টাকা উপার্জন করছে।
এক সময় যে সন্তানকে বোঝার মতো বয়ে বেড়িয়েছেন, তাকে নিয়ে আজ গর্বিত বাবা মহেন্দ্র রায়। তিনি বলেন, এখন মানুষ জিতুর জন্য আমায় অনেক সম্মান দেয়। আমাকে না দিলেও, আমি তার বাবা হিসেবে অনেকের সম্মান পাচ্ছি। এখন আমি আমার ছেলেকে নিয়ে অনেক গর্বিত।
প্রচলিত নিয়মে জিতুর মতো উদ্যোক্তাদের সহায়তার সুযোগ না থাকলেও সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলে সহায়তার আশ্বাস দিলেন সরকারের সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তা। রংপুর শহর সমাজসেবা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম পাইকাড় বলেন, তাকে সহায়তা করার মতো আমাদের কাছে ক্ষমতা নেই। উনি যদি মন্ত্রণালয়ের বা অধিদফতরের কাছে ঋণের জন্য আবেদন করতে পারেন।
উল্লেখ্য, জিতু রায়ের জন্ম ১৯৮৮ সালের ৯ সেপ্টম্বর রংপুর নগরির তাজহাটে। মহেন্দ্র-মঞ্জু দম্পতির ৩ ছেলেমেয়ের জিতু বড়। তার দুইটি সন্তান রয়েছে।