সম্প্রতি ভারত জানিয়েছে, নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা আর গম রফতানি করবে না। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের বাজারে গমের সংকট দেখা দেওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত গম রফতানি বন্ধ করে দিলে আদৌ কি বাংলাদেশে সংকট সৃষ্টি হবে?
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের আগে বাংলাদেশ কখনই গমের জন্য ভারতের ওপরে সিংহভাগ নির্ভর ছিল না। পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে ৪৫ শতাংশ গম আমদানি করেছে। বাংলাদেশের গম আমদানির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কানাডা। বাংলাদেশ ২০২০-২১ অর্থবছরে কানাডা থেকে ২৩ শতাংশ ও ভারত থেকে ১৭ শতাংশ গম আমদানি করেছে। এছাড়া বাকি ১৫ শতাংশ গম অন্যান্য মাধ্যম থেকে আমদানি করেছে বাংলাদেশ।
তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষার্ধে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার সংঘাত শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় গম আমদানি। এক্ষেত্রে গম আমদানির জন্য বাংলাদেশকে ঝুঁকতে হয় ভারতের দিকে। মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কেবল ভারত থেকে ৬৩ শতাংশ গম আমদানি করেছে। কানাডা ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে যথাক্রমে ১৪ ও ২৩ শতাংশ গম আমদানি করেছে বাংলাদেশ।
কিন্তু কোনো ধরনের পূর্বাভাস ছাড়াই শুক্রবার (১৩ মে) ভারত জানিয়েছে তার আর গম আমদানি করবে না। তবে আমদানির পথ একেবারে সিলগালা করে দেয়নি ভারত। আপাতত বাংলাদেশ দুটি চোরাগলির সুবিধা ব্যবহার করতে পারলে গম সংকট থেকে বেঁচে যেতে পারবে বলে মনে করেন বিষেশজ্ঞরা।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) জানিয়েছে দুটি ক্ষেত্রে গম রফতানি করা যাবে। প্রথমটি হচ্ছে ইতিমধ্যে খুলে ফেলা যেসব ঋণপত্র (এলসি) বাতিলযোগ্য নয়, তার বিপরীতে। অপরটি খাদ্য ঘাটতিতে থাকা দেশের সরকারের অনুরোধের বিপরীতে ভারত সরকার অনুমতি দিলে। দুটো বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সুবিধা বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারলে গম সংকট থেকে মুক্তি পাবে বাংলাদেশ।
ভারত থেকে চুক্তিবদ্ধ গম আনা সম্ভব হলে আগামী ৩-৪ মাস গমের সংকট হবে না। এর মধ্যে বাংলাদেশের মাঠেই দেখা দিবে নতুন গমের ফলন। এছাড়াও তিন-চার মাস পর পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের ফলন আসবে বাজারে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে গম আমদানি অব্যাহত রাখতে পারবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে বেসরকারি খাত নিয়ে। বাংলাদেশের সিংহভাগ গম বেসরকারি খাতে আমদানি হয়।
এ ব্যাপারে খাদ্যসচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম বলেন, ভারত থেকে আরও গম আনতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুক্তি করা নিয়ে কথা চলছে। বেসরকারি খাত যদি গম আমদানির ব্যাপারে সহায়তা চায়, তাহলে লিখিতভাবে চাইতে হবে। আমরা অবশ্যই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সে চেষ্টা করব।
উল্লেখ্য, গম বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। দেশে বছরে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টন চাল ও ৭৫ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। গমের ১১ লাখ টনের মতো দেশে উৎপাদিত হয়। বাকিটা আমদানি করা হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে গত ১ জুলাই থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে মোট ৫৫ লাখ ৪৬ হাজার টন গম দেশে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, বাংলাদেশের গম আমদানি দাঁড়াবে ৭৫ লাখ টন।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশটি নিজেদের ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে (এপ্রিল-ফেব্রুয়ারি) প্রায় সাড়ে ৬৬ লাখ টন গম রফতানি করেছে, যার ৫৭ শতাংশেরই গন্তব্য ছিল বাংলাদেশ।
এদিকে ভারত গম রফতানি বন্ধ করেছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজধানীর বাজারে বেড়ে যায় গমের দাম। অনেকেই আবার বেশি করে গম কিনে রাখতে শুরু করেছেন।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, ঢাকার বাজারে শনিবার (১৪ মে) প্রতি কেজি আটার দাম ছিল ৩৮-৪৫ টাকা, যা এক বছর আগের তুলনায় ৩৪ শতাংশ বেশি। আর খোলা ময়দার কেজি ছিল ৫৬ থেকে ৬০ টাকা। এক বছরে খোলা ময়দার দাম বেড়েছে ৬৩ শতাংশ।
একইভাবে পাইকারি বাজারেও বেড়েছে গমের দাম। চট্টগ্রামের বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে শনিবার (১৪ মে) ভারতীয় গমের দাম কেজিপ্রতি ১ টাকা ৩৪ পয়সার মতো বেড়েছে। বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৪০ টাকা ১৯ পয়সা দরে।
তবে গমের দামের লাগাম টেনে ধরা অসম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী। তিনি বলেন, গমের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় মূল্য বা দাম বেঁধে দিতে পারে। এটি হলে ডলারের দামের জন্য এখন যে কেজিপ্রতি ৮-১০ টাকা দাম বেড়ে যাচ্ছে, তা হবে না।