ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটে ভারত। গেল ছয় বছরে দেশটির জনগণকে এমন প্রকট সমস্যায় পড়তে হয়নি। এবার বিদ্যুৎ ঘাটতি ভালোই ভোগাচ্ছে তাদের।
দক্ষিণ এশিয়ার একটি বিশাল অঞ্চলজুড়ে দাবদাহ বয়ে চলছে। ভারতকেও পোড়াচ্ছে আবহাওয়ার চরম তাপমাত্রা। এতে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। কিন্তু সেই অনুসারে উৎপাদন না হওয়ায় লোকজনকে দিনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় বিদ্যুতবিহীন থাকতে হচ্ছে।-খবর রয়টার্সের
চলতি বছরে নিরবচ্ছিন্ন তাপপ্রবাহে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ও রেফ্রিজারেটরের চাহিদা ব্যাপক বেড়েছে। এছাড়া করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আরোপ করা বিধিনিষেধ উঠিয়ে দেওয়ায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দিকে যাচ্ছে ভারত। বেড়েছে শিল্পকারখানার কার্যক্রম ও তৎপরতা। এপ্রিলে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল সর্বোচ্চ রেকর্ড পরিমাণ।
মহামারির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হাইব্রিড কর্মপরিবেশের মডেল গ্রহণ করা হয়েছে। ২০২০ সালে শুরু হওয়া করোনার কারণে কয়েক লাখ ভারতীয় তাদের বাসা থেকে অফিস করছেন। এতে দিনের বেলায় বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ ব্যবহার বেড়েছে।
রাতের বেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ব্যবহারের মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরি হয়েছে। সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে রাতে, আবার এয়ারকন্ডিশনের চাহিদা থাকে চড়া। গরম থেকে বাঁচতে মানুষ বেপরোয়া। তারা রাতভর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার করছেন।
আবার অনেক বিদ্যুৎ চুল্লির জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে। উৎপাদন বাড়াতে অতিরিক্ত জ্বালানির প্রয়োজন হলেও মজুত সীমিত। ভারতে গেল ৯ বছরের মধ্যে গড় কয়লা মজুত সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে।
কয়লা পরিবহণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির রেলপথ পর্যাপ্ত ট্রেনের ব্যবস্থা করতে পারছে না। এছাড়া মজুতের ঘাটতি পূরণ করতে পারেনি দেশটির রাষ্ট্রপরিচালিত কয়লা কোম্পানিও। অথচ কয়লা উৎপাদনের আশি শতাংশ আসে এই কোম্পানি থেকে।
তাপ কয়লা আমদানি কমিয়ে শূন্যতে নিয়ে আসার নীতি গ্রহণ করেছিল ভারত। এবার সেই নীতি থেকে পুরোপুরি সরে এসে উল্টো সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আগামী তিন বছর তাপ কয়লা আমদানি করতে কোম্পানিগুলোতে বলছে সরকার।
এছাড়া আমদানি নির্ভর কয়লা পরিচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে উৎপাদন শুরু করতে একটি জরুরি আইন প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে কয়লার আকাশছোঁয়া মূল্য থাকায় এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে।
মজুত কম থাকায় অন্য খাতে কয়লা সরবরাহ বন্ধ রেখে তা বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কয়লা কোম্পানি।
কয়লা সরবরাহ অব্যাহত রাখতে যাত্রীবাহী ট্রেনযাত্রা বাতিল করতে হচ্ছে। আগে অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক ঘোষিত শতাধিক কয়লা খনি নতুন করে উন্মুক্ত করে দেওয়ারও পরিকল্পনা নিয়েছে ভারত।
৩৫ হাজার নাগরিকের সাক্ষাতকার নিয়ে নাগরিক জরিপ প্ল্যাটফর্ম লোকারসারকেলস বলছে, এসব মানুষ নিয়মিত লোডশেডিংয়ের শিকার হচ্ছেন।
কর্তৃপক্ষ বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে না-পারায় অন্তত তিনটি রাজ্যের কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে। যেহেতু বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে কয়লা সরবরাহ সীমিত ছিল, সেহেতু সরাসরি গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে কারখানাগুলো। এতে শিল্পখাতের খরচ বেড়েছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ওপরও চাপ বাড়ছে।
চলতি মাসে গুজরাট ও অন্ধ্যপ্রদেশে শিল্পকারখানার কার্যক্রম সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। কারণ রাজ্য দুটির বাসাবাড়িতে এয়ার কন্ডিশনের চাহিদা বেড়েছে।
অক্টোবর-মার্চে উড়িষ্যার পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে ৩০ শতাংশ। গড় জাতীয় প্রবৃদ্ধির চেয়ে যা প্রায় তিনগুণ বেশি। রাজ্যটিতে ভারতের সবচেয়ে বড় অ্যালুমিনিয়াম ও ইস্পাত কারখানা।
কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, কয়লার মজুত কম থাকায় অনেক বেশি বিদ্যুৎ সংকটে পড়তে হয়েছে ভারতকে। আর গেল ৩৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বিদ্যুতের চাহিদা।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন চলতি বছরে ১৭ দশমিক ছয় শতাংশ বাড়বে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ভারতের বার্ষিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৭৫ শতাংশ আসে এসব কেন্দ্র থেকে।
জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে সরকারি কয়লা কোম্পানির উৎপাদন ও তা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পাঠানো ব্যাহত হতে পারে। কারণ ভারী বৃষ্টি ও প্লাবনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
গত অক্টোবরে ভারতে সর্বশেষ বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছে। কিন্তু চলতি মাসের সংকট ব্যাপক বিস্তৃত। দেশের অর্ধেক অঞ্চলের মানুষকে অক্টোবরের চেয়ে বেশি সময় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়েছে।