কথায় আছে, কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ। করোনা মহামারি বেশিরভাগ মানুষের জন্য অভিশাপ হলেও ব্যবসায়ীদের জন্য তা ‘আশীর্বাদ’ হয়ে এসেছে। মহামারির দুই বছরে রীতিমতো ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ ব্যবসায়ীরা।
এ সময়ের মধ্যে বিশ্বে বিলিয়নিয়ার তথা শত কোটি ডলারের মালিকের সংখ্যা বেড়েছে ৫৭৩ জন। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় বিলিয়নিয়ার হয়েছেন একজন। ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা অক্সফামের এক রিপোর্ট মতে, মহামারিকালে বিলিয়নিয়ারদের মোট সম্পদ বেড়েছে ৪৫ হাজার ৩০০ কোটি ডলার।
যেভাবে সম্পদ বেড়েছে
২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বজুড়ে করোনার তাণ্ডব শুরু হয়। এর মোকাবিলায় নানা বিধিনিষেধ আর লকডাউনের ফলে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় খাদ্যের দাম চড়তে শুরু করে। করোনার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শুরু হলো ইউক্রেন সংঘাত। যার ফলে আরেকবার অস্থির হয়ে ওঠে খাদ্যপণ্যের বাজার। বাড়ে জ্বালানির দামও। খাদ্য ও জ্বালানির এ দামবৃদ্ধিই ব্যবসায়ীদের ‘আশীর্বাদ’ হয়ে এসেছে ব্যবসায়ীদের জন্য। যার ফলে তাদের সম্পদও বেড়ে নজিরবিহীনভাবে।
বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বেড়েছে ৫৭৩ জন
রোববার (২২ মে) থেকে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে শুরু হয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম শীর্ষ সম্মেলন। এতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জড়ো হয়েছেন রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী নেতারা। সম্মেলনের দ্বিতীয় সোমবার (২৩ মে) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল। ‘প্রোফিটিং ফ্রম পেইন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিলিয়নিয়ারদের নিয়ে বিস্ময়কর সব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
অক্সফাম বলছে, বিশ্বে মোট বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা এখন ২ হাজার ৬৬৮। যা ২০২০ সালের থেকে ৫৭৩ জন বেশি। বিশ্বের প্রথম ১০ ধনীর সম্পদ ৩০০ কোটি মানুষের থেকেও বেশি। সবচেয়ে ধনী ২০ বিলিয়নিয়ারের সম্পদের পরিমাণ সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোর মোট জিডিপি থেকেও বেশি।
খাদ্য ও জ্বালানি ব্যবসায় নতুন বিলিয়নিয়ার ৬২
অক্সফামের প্রতিবেদন মতে, বিশ্বজুড়ে দুই বছরে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বেড়েছে ৫৭৩ জন। এর মধ্যে খাদ্যের দামবৃদ্ধির কল্যাণে মাত্র ২৪ মাসে খাদ্য ব্যবসায় জড়িত বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বেড়েছে ৬২ জন। বিশ্বের অন্যতম খাদ্য ব্যবসায়ী কারগিল পরিবারে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা এখন ১২। যা মহামারির আগ পর্যন্ত ছিল ৮ জন। মার্কিন এই পরিবারটি তিনটি পৃথক পৃথক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বৈশ্বিক খাদ্য ও কৃষিবাজারের ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
অক্সফামের পরিচালক গ্যাব্রিয়েলা বুচার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে শত শত বিলিয়নিয়ার তাদের ভাগ্যের অবিশ্বাস্য সাফল্য উদযাপন করছেন। করোনা মহামারি ছাড়াও তাদের সৌভাগ্যের চাবিকাঠি হয়ে উঠেছে খাদ্য ও জ্বালানির দাম।’ বুচার আরও বলেন, বিলিয়নিয়ারদের এই অর্থবৃদ্ধির কারণ তাদের বুদ্ধি ও শ্রম নয়। তাদের সম্পদ বেড়েছে মূলত শ্রমিকদের ঠকিয়ে ও কর ফাঁকির মতো অগ্রহণযোগ্য পন্থায়।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার মধ্যে খাদ্য ও জ্বালানির বৃদ্ধির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাড়তি মুনাফা তুলে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। মাত্র ২৪ মাসে সম্পদ বেড়েছে ৪৫ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ প্রতি দুইদিনে গড়ে ১০০ কোটি ডলার। মুনাফার শীর্ষে রয়েছে বিপি, শেল, টোটালএনার্জিস, এক্সসন ও সেভরনের মতো বৃহৎ জ্বালানি কোম্পানিগুলো। এই পাঁচটি শীর্ষ কোম্পানি সম্মিলিতভাবে প্রতি সেকেন্ডে মুনাফা করছে ২ হাজার ৬০০ ডলার।
ওষুধ ব্যবসায় নতুন বিলিয়নিয়ার ৪০ জন
শুধু খাদ্যপণ্যই ও জ্বালানি নয়, করোনায় রমরমা ব্যবসা হয়েছে ওষুধ খাতেও। ওষুধ বাণিজ্যে বিলিয়নিয়ার হয়েছে ৪০টি নতুন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। মডার্না ও ফাইজারের মতো ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলো কোভিড টিকায় আধিপত্য স্থাপনের মাধ্যমে প্রতি সেকেন্ডে লাভ করছে ১০০০ ডলার। করোনা টিকার ক্ষেত্রে সরকারগুলোর থেকে উৎপাদন খরচের থেকে প্রায় ২৪ গুণ বেশি দাম নিয়েছে কোম্পানিগুলো।
বাড়ছে দরিদ্রদের সংখ্যাও
এক বছর আগের তুলনায় বর্তমানে খাদ্যের দাম গড়ে ৩০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। যা মহামারির আগের তুলনায় ২৬ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি মানুষকে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অক্সফামের প্রতিবেদন মতে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ দারিদ্র্যসীমার নিচে (দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম আয় যাদের) জীবনযাপন করা মানুষের সংখ্যা ৮৬ কোটিতে উন্নীত হবে। এটা যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও স্পেনের সম্মিলিত জনসংখ্যার সমান।
অক্সফাম যুক্তরাজ্যের প্রধান নির্বাহী ড্যানি শ্রীসকন্দরাজা বলেন, ‘এটা নৈতিকভাবে অসমর্থনযোগ্য যে যখন পূর্ব আফ্রিকার লোকরা ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে, তখন খাদ্য ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে অতিধনীদের সম্পদ নজিরবিহীনভাবে বাড়ছে। একদিকে উচ্চ খাদ্যমূল্যের কারণে লাখ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি হচ্ছে। অন্যদিকে একই কারণে নতুন নতুন বিলিয়নিয়ার তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় সম্পদের বৈষম্য নিরসনে বিপুল পরিমাণ মুনাফা ও সম্পদের দিকে সরকারের নজর না দেয়ার কোনো অজুহাত থাকতে পারে না।’
চরম দারিদ্র্যের বৃদ্ধি মোকাবিলায় সহায়তার জন্য অবিলম্বে অতিধনীদের ওপর ‘সম্পদ কর’ চালুর আহ্বান জানিয়েছে অক্সফাম। দাতব্য সংস্থাটি জানিয়েছে, সরকারগুলোকে আর্জেন্টিনার উদাহরণ অনুসরণ করা উচিত। পাশাপাশি মহামারি বিপর্যয় কাটাতে বিলিয়নিয়ারদের ওপর এককালীন সংহতি কর চালুরও আহ্বান জানানো হয়।
সংস্থাটি বলেছে, বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও একচেটিয়া ক্ষমতার লাগাম টানতে স্থায়ী সম্পদ কর চালু করা খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে মিলিয়নিয়ারদের জন্য ২ শতাংশ থেকে শুরু হওয়া বার্ষিক সম্পদ কর এবং বিলিয়নিয়ারদের জন্য ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ালে বছরে ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি ডলার রাজস্ব আসতে পারে।
অক্সফাম জানিয়েছে, এ অর্থ দিয়ে ২৩০ কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে, বিশ্বের জন্য পর্যাপ্ত টিকা এবং নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে বসবাসকারী প্রত্যেকের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সুরক্ষা দেয়া সম্ভব। মাত্র ৩২টি অতিলাভজনক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর এ ধরনের কর ২০২০ সালে ১০ হাজার ৪০০ কোটি ডলার রাজস্বের জোগান দিতে পারত।