চতুর্থ মাসে পড়তে যাচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠছে সংঘাতের অর্থনৈতিক খেসারত। মানুষের নিত্য জীবন যাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। জ্বালানিসহ দ্রব্যমূল্য দরিদ্রদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
যুদ্ধে যে আর্থিক মূল্য চোকাতে হচ্ছে, তা এখন বৈশ্বিক রাজনৈতিক এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে। রাশিয়ার সামরিক অভিযানের রাজনৈতিক অভিঘাত ইউক্রেন ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে পড়তে শুরু করেছে। যুদ্ধের ও এর পরিণতি সবাইকে ভোগান্তিতে ফেলছে।
ইউক্রেনের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত বিপর্যয় খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে প্রচুর পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া অবকাঠামোগুলো নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সংঘাতের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক গতিশীলতার মাধ্যমে কীভাবে তা আরও ব্যাপকতর হচ্ছে, সেদিকে নজর দিতে হবে।
কিছু পূর্বাভাস বলছে, ২০২২ সালে ইউক্রেনের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ কমে গেছে। যুদ্ধ শেষ হলে এই নেতিবাচক প্রবণতা কাটিয়ে ওঠা যাবে। ইউক্রেনের অবকাঠামো খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মে মাসের শুরুর দিকের এক হিসাব বলছে, যা আট হাজার কোটির কাছাকাছি হবে।
সবমিলিয়ে দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি কমে আসবে। কারা অর্থায়ন করছে কিংবা কতটা ভালোভাবে হচ্ছে; তা এখানে মোটেও বিবেচ্য হবে না।
একইভাবে, একটি অস্ত্রবিরতি কিংবা শান্তি চুক্তি হলে নিজেদের সীমান্ত থেকে ইউরোপমুখী ইউক্রেনীয়দের ঢল বন্ধ হবে। বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হয়ে থাকা ৬০ লাখেরও বেশি ইউক্রেনীয় দেশে ফিরতে উদগ্রীব হয়ে যাবেন। এছাড়া অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়া ৮০ লাখ ইউক্রেনীয় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাবেন।
যেসব শরণার্থী দেশে ফিরবেন, তাদের অনেকেই নিজেদের বাড়িঘরের অস্তিত্ব খুঁজে পাবেন না। রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র তা হয়ত মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। এছাড়া কর্মসংস্থান ও জনসেবার সংকটের বিষয়টিও থাকছে।
এর সঙ্গে যোগ হবে ব্যাপক হতাহতের সংখ্যা। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের নাগরিকেরা ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছেন। জনসংখ্যার বড় অংশটিকেই মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে তাদের অনেক সময় লাগবে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় মানব সক্ষমতারও উল্লেখযোগ্য ঘাটতি তৈরি হবে। জনবল সংকট ভয়বহ রূপ নিতে পারে।
এবার ইউক্রেনের প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতির গতিতেও ঢিলেমি চলে আসবে। নতুন করে মন্দার আশঙ্কাও করা হচ্ছে। এটিই তেল-গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিতিশীলতার প্রাথমিক কারণ। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কখন তা শেষ হবে, তা নিয়েও রয়েছে চরম অনিশ্চয়তা।
ব্যাপক খাদ্য-সংকট
ইউক্রেন যুদ্ধের অন্য অর্থনৈতিক ঝক্কির মধ্যে আছে অসহনীয় খাদ্য সংকট। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীগুলো। কৃষিপণ্যের বড় রফতানিকারক দেশের মধ্যে একটি ইউক্রেন। বিশেষ করে সূর্যমুখী তেল ও গম উৎপাদনের জন্য দেশটি বিখ্যাত।
রাশিয়ার কার্যত নৌ অবরোধে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রফতানি পথ ও কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী বিভিন্ন বন্দরও অকার্যকর হয়ে গেছে।
রাশিয়া নিজেও একটি বড় গম রফতানিকারক দেশ। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের দাবি, ইউক্রেনের বিভিন্ন গুদাম থেকে প্রায় চার লাখ টন খাদ্যশস্য চুরি করেছে মস্কো। এটি কেবল ইউক্রেনের চলমান খাদ্যশস্য ঘাটতির জন্যই দায়ী না, এ ঘটনা বৈশ্বিক খাদ্য সংকটকে ত্বরান্বিত করছে।
ইউক্রেনের আসন্ন ফসল উৎপাদনকে ঘিরে বাজারেরও প্রত্যাশা তৈরি হয়। বহুদিন ধরে থাকে এই প্রত্যাশা। কিন্তু যুদ্ধে সেই আশার গুড়ে বালি পড়েছে। বেড়ে গেছে খাদ্যশস্য ও ভোজ্য তেলের দাম। রফতানি এখন কম-সাশ্রয়ী, বিপাকে পড়েছে দারিদ্র্য দেশগুলো। আমদানি খরচ বেশি হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দেখা গিচ্ছে।
এমনকি ধনী অর্থনীতির দেশগুলোতে জ্বালানির চড়া দাম। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় ঊর্ধ্বমুখী। যা বৈশ্বিক মন্দাকে সম্ভাব্য করে তুলেছে। যেখানে মহামারির ধকল কাটিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কথা ভাবা হচ্ছিল, সেখানে দীর্ঘ মন্দার শঙ্কা তৈরি করেছে যুদ্ধ।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সেই ধাক্কা কতটা জোরালো হবে, তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় বিশেষজ্ঞরা।
এসব কিছু অবশ্য কেবল যুদ্ধের দরুন হচ্ছে এমন না, যুদ্ধের বিভিন্ন পরিণতিও একটি বড় অনুঘটক এখানে। এতে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষত আরও রগরগে হয়ে উঠেছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। এছাড়া নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে যাওয়া বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি ও দেশগুলোও মাধ্যমিক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যে কোনো দেশকে দেওয়া শাস্তি প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা কবলিত দেশগুলোর বৈধ এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না, এমন ব্যক্তি কিংবা সংস্থার বিরুদ্ধে যখন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়, তখন তা মাধ্যমিক নিষেধাজ্ঞা। কারণ প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞায় যা বৈধ না, সেসব কার্যক্রমে জড়িত ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মাধ্যমিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
নিষেধাজ্ঞা এমনভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে, তাতে বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তাদের সম্পর্কের ফাটল গভীর হচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিক লেনদেনের চাকা। এতে বিশ্বায়নের বর্তমান মাত্রা ছোট হয়ে আসছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামোগত পরিবর্তন ঘটছে।
রাশিয়ার তেল রফতানির বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আসন্ন নিষেধাজ্ঞাই তা স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার বন্ধ করতে চাচ্ছে ইউরোপ। একইসময়ে একটি বড় সংখ্যক পশ্চিমা কোম্পানি রাশিয়ার বাজার ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
চীন-মার্কিন সম্পর্কে ভবিষ্যৎ
খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা না-হলেও সত্যি যে ইউক্রেন যুদ্ধে চীন-মার্কিন অর্থনৈতিক দূরত্ব বাড়ছে। এই দুই বড় শক্তির বিভক্তি আরও বড় আকার নিচ্ছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের জবাবে পশ্চিমাদের পদক্ষেপ থেকে চীনের জন্য অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। তার মধ্যে একটি—যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও অন্যান্য মিত্রের নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার ছয় হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রায় অর্ধেক বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণের মজুত জব্দ হয়েছে। এতে ভবিষ্যতে বিদেশি ডলার সঞ্চায়নে আরও সতর্কতা অবলম্বন করবে চীন। পশ্চিমারা যাতে সহজেই তাদের সম্পদ জব্দ করতে না পারে—তা নিশ্চিত করতে বেইজিং আগেভাগেই পদক্ষেপ নেবে।
পরিবর্তিত সম্পর্কের আরও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব আছে। এতে ভূ-অর্থনীতি ও রাজনীতি অনেক বেশি একপেশে হয়ে যাবে। বৈশ্বিক শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে চীন-মার্কিন পরস্পরের বিপরীত অবস্থানে চলে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ গতিতে দুই পরাশক্তির মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে। তারা আগের অবস্থানে কখনো ফিরবে কিনা; তা কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। একটি হচ্ছে, কখন ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটে।
যুদ্ধ যতটা দীর্ঘতর হবে, অর্থনৈতিক বিভক্তি তত বেশি হবে। এর সঙ্গে জুড়ে যাবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। ইউরোপীয় ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এই বিভাজন আরও গভীর হবে। চীন কীভাবে পদক্ষেপ নেয় কিংবা দেশটি তার অর্থনৈতিক স্বার্থকে কতটা অগ্রাধিকার দেয়, তা আমলে নেওয়া এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থাৎ অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বেইজিং বাণিজ্য সম্পর্ক অব্যাহত রাখবে নাকি একনায়কদের নিরাপদ বিশ্ব প্রতিষ্ঠায় রাশিয়ার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবে, তার ওপর নির্ভর করছে পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক।
ব্রিকস নামে পরিচিত ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে চীন যদি নিখাদ জোট গড়তে পারে, তবে নতুন এক বিশ্ব ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটবে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এমন স্বপ্নই দেখছেন।
*এশিয়া টাইমস অবলম্বনে