সমস্ত আয়োজন শেষ। দুইদিন পরেই খুলে যাবে পদ্মা সেতু। দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের বিপ্লব ঘটাবে এই সেতুর উদ্বোধন। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী আলোচিত আর দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের বহুল আকাঙ্খার ফলস সেতুটি নিয়ে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। নদী মাতৃক বরিশালের সাথে রাজধানীর যোগাযোগের বিলাসবহুল লঞ্চ সেক্টর নিয়ে উদ্বেগেরও কমতি নেই। সরকারি দফতর আর লঞ্চ মালিকরা বলছেন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের প্রথম ছয় মাস যাত্রী সংকট দেখা দিবে। এরপর পর্যাক্রমে স্বাভাবিক হয়ে আসবে এই রুটের জনপ্রিয়তা। এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিও উত্থাপন করেছেন লঞ্চ মালিকরা। তবে সকল শঙ্কা কাটিয়ে আসন্ন ঈদ-উল-আযহায় বরিশাল-ঢাকা নৌ-রুটে যুক্ত হচ্ছে আরো তিনিটি বিলাসবহুল নতুন লঞ্চ।
বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, দেশের মধ্যে সদরঘাটের পর সবচেয়ে ব্যস্ত ও জনবহুল নদী বন্দর বরিশাল। এখানে প্রতি ঈদে-কুরবানিতে যাত্রীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। তাছাড়া বিলাসবহুল লঞ্চ সারা বছরই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে আরামদায়কভাবে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। এরমধ্যে ঢাকার সাথে যাত্রী পারাপার করে রোটেশনে ৭টি। আর ঈদের সময়ে ২৫টি। এছাড়াও অভ্যান্তরীণ রুটে আরো ৩০টির মত লঞ্চ রয়েছে।
বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা ও বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পদ্মাসেতু চালুর পরে লঞ্চ সেক্টরে যাত্রী সংকটের কিছুটা প্রভাব পড়বে। তারপরও আসন্ন ঈদ-উল-আযহায় দুটি কোম্পানীর বিলাসবহুল তিনটি লঞ্চ রুটে যুক্ত হওয়ার কথা শুনেছি। যদিও লঞ্চ কোম্পানীগুলো অফিসিয়ালভাবে এখন পর্যন্ত অবহিত করেনি। এই কর্র্মকর্তা বলেন, পূর্ব নির্ধারিত লঞ্চ ভাড়াই এখনো রয়েছে। লঞ্চ মালিকরা কমানোর কোন সিদ্ধান্ত নেননি। তবে উদ্বোধনের কয়েকমাস পর্যবেক্ষণ করবেন তারা বলে আমাকে জানিয়েছেন, এরপরই মূলত সিদ্ধান্ত গ্রহন করবেন।
সুরভী শিপিং লাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াজ-উল-কবির বলেন, পদ্মাসেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চল উন্নয়নের স্বর্ন যুগে প্রবেশ করবে। সেই উন্নয়নের সুবিধাভোগী আমরাও। ফলে পদ্মা সেতু আমাদের সৌভাগ্যের প্রতিক। কিন্তু একটি সেক্টরে যখন যুগান্তকারী উন্নয়নের ছোয়া লাগে তখন অন্য কিছু অংশ ক্ষতি হবে এটি স্বাভাবিক। এসব মেনে নিতে হবে বৃহৎ স্বার্থেই। পদ্মাসেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাড়াবে ২.২১ শতাংশ। আপনারা জানেন এর আগে দক্ষিণাঞ্চল পুরো দেশ থেকে একটি নদীর কারনে বিচ্ছিন্ন ছিল। এখন যেহেতু সেতুর মাধ্যমে পুরো দেশ যুক্ত হচ্ছে তখন এই অঞ্চলে বিভিন্ন ধরণের শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। তখন যাত্রীর সংখ্যা বাড়বে।
রিয়াজ উল কবির বলেন, বিভিন্ন কাজে যত মানুষ আসবে তার ১০ শতাংশ যাত্রী পেলেই লঞ্চ ব্যবসায় টিকে থাাকা সম্ভব। অন্যথায় লঞ্চ চলাচলের খরচই উঠানো সম্ভব না। যাত্রী আকৃষ্ট করতে লঞ্চ কর্তৃপক্ষকেও নতুন পরিকল্পনা করতে হবে। লঞ্চগুলোকে আরো সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন করতে হবে। দ্রুত গতির ও আধুনিক করতে হবে। তার মতে, পদ্মাসেতু চালু হলে মারাত্মক যাত্রী সংকটে পড়বে ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চগুলো। এজন্য সুরভী শিপিং লাইন্স সিদ্ধান্ত নিয়েছে নতুন করে আর কোন লঞ্চ নির্মাণে হাত দিবে না। আর যারা এখন নতুন করে নামাাচ্ছেন তারা সের্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়েছেন। নির্মাণ খরচ উঠাতে পারেন কিনা তা নিয়েই সংশয় এই লঞ্চ মালিকের।
নিজাম শিপিং লাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজাম উদ্দিন সিআইপি বলেন, পদ্মাসেতু উুদ্বোধনে লঞ্চ সেক্টরে যাত্রী সংকটের বিশেষ প্রভাব পড়বে বলে আমি মনে করি না। কারন দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণ মানুষ ২৫০/৩০০ টাকায় একমাত্র লঞ্চেই ঢাকা যেতে পারে। বাসে কিন্তু তা সম্ভব নয়। আর লঞ্চ সাধারণত সাধারণ যাত্রীদের গুরুত্ব দিয়েই টিকে রয়েছে। তবে হ্যাঁ সেতু চালু হওয়ার পরে কেবিনের যাত্রী সংকট দেখা দিতে পারে। কারন ভিআইপিরা নিজেদের গাাড়ি নিয়ে সরাসরি যাতায়াত করবে। তিনি বলেন, আরেকটি বিষয় হচ্ছে সড়ক পথের তুলনায় নৌ-পথে পন্য পরিবহনে খরচ কম।
সুরভী শিপিং লাইন্সের পরিচালক রেজিন উল কবির বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরে ৩০ শতাংশ যাত্রী কমবে। আর প্রথম ৬ মাস যাত্রীরা সড়ক পথে ভ্রমন করে ঢাকা যাবেন। কিন্তু তাতে কর্মঘন্টা নষ্ট হবে। এটি স্পষ্ট যে মানুষ যারা লঞ্চে যাচ্ছেন তারা রাতে ঘুমিয়ে যাচ্ছেন অর্থাৎ তার কর্ম ঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। অথচ বাসে যারা যাবেন তারা কিন্তু কর্মঘন্টা নষ্ট করেই যাবেন। এটি বুঝতে কিছুটা সময় লাগবে যাত্রীদের। যখন কর্মঘন্টার হিসেব বুঝতে পারবেন তখন লঞ্চে গিয়ে কাজ সেরে বাসে ফিরে আসবে। অর্থাৎ যাত্রী সংকটের কিছুটা প্রভাব পড়লেও পর্যায়ক্রমে সেই ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা যাবে বলে মনে করি।
এম খান গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান খান বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুরর পরিমানে কল-কারখানা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। উন্নয়ন হবে। এতে করে এই অঞ্চলে মানুষ বেশি আসবে। সে কারনে লঞ্চে যাত্রী সংকট ওই অর্থে সৃষ্টি হবে না। তবে প্রথম দুই থেকে ৬ মাস হয়তো সংকট দেখা দিবে। তারপর পর্যায়ক্রমে সেই সংকট কেটে যাবে। তিনি বলেন, প্রথম অবস্থায় যাত্রী সংকটের ঝুঁকি জেনেও এই ঈদে এম খান-৭ ও এম খান-১১ নামের দুটি লঞ্চ নৌ-রুটে যুক্ত হয়ে যাত্রী পরিবহন শুরু করবে। এসব লঞ্চে থাকবে লিফট, চলন্ত সিঁড়ি, এটিএম বুথ, হেলিপ্যাড, সুইমিং পুল, নামাজের কক্ষ, ডাইনিং, শিশুদের খেলার জোন, রেস্টুরেন্ট, ব্রেস্টফিডিং রুম ও রোগীদের জন্য আইসিইউ সুবিধা। ফলে যাত্রীরা অবশ্যই আরামদায়ক ও নিরাপদে যেতে লঞ্চরুটকে বেছে নিবেন।
বরিশাল চেম্বাার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি ও সুন্দরবন নেভিগেশনের মালিক সাইদুুর রহমান রিন্টু বলেন, সড়ক পথের সাথে নৌ-পথের কোন তুলনা হয় না। নৌ-পথ হচ্ছে আরামদায়ক ও নিরাাপদ যাত্রার পথ। এজন্য পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর নৌ রুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলোতে কোনরুপ যাত্রী সংকট দেখা দিবে বলে আমি মনে করি না। যে কারনেই আসন্ন ঈদ-উল-আযহায় সুরন্দরবন-১৬ লঞ্চটি যাত্রী পরিবহনে যুক্ত করবো। লঞ্চটির নির্মাণ প্রায় শেষ। এখন শেষ মুহুর্তের রঙ করার কাজ চলছে। তিনি বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ তিনি আমাদেরকে পদ্মাসেতু উপহার দিয়েছেন। এর মাধ্যমে গোটা দক্ষিণাঞ্চলের চিত্র পাল্টে যাবে।