গত ৮ জুন রাজধানীর হাতিরঝিল নিকেতন এলাকার লেকপাড় থেকে ডিবিসি নিউজের প্রযোজক আব্দুল বারীর রক্তাক্ত মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধার করা আব্দুল বারীর মৃতদেহের পেটে এবং গলায় ধারালো ছুরি দিয়ে পোজ দেওয়া ছিল। এমনকি যে ছুরি দিয়ে পোজ দেওয়া হয়েছে সেই ছুরিও পড়েছিল মৃতদেহের পাশে। কিন্তু রক্তাক্ত দেহ দেখে সে সময় পুলিশের ধারণা ছিল এটি হত্যাকাণ্ড এবং কোনো ছিনতাইকারী বা তাদের সংঘবদ্ধ চক্র এমন ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু মাসখানেকের অব্যাহত তদন্তে মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে বেরিয়ে এলো পিলে চমকানো তথ্য।
গণমাধ্যমকর্মী আব্দুল বারীর মৃতদেহ উদ্ধারের পর রহস্য উদঘাটনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিশন (র্যাব) যৌথভাবে ঘটনার তদন্ত শুরু করে। তদন্তে ডিজিটাল এবং এনালগ পদ্ধতিতে আব্দুল বারীর ব্যক্তিজীবন ও পেশাগত জীবন এবং মৃত্যুর আগের তার গতিবিধি নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করে ডিবির গুলশান বিভাগের টিম প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন যে- আব্দুল বারীকে কেউ খুন করেনি। বরং তিনি নিজেই নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
শনিবার (১৬ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর ডিবির কার্যালয়ে আব্দুল বারীর মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে এমন পিলে চমকানো তথ্য দেন ডিবির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মশিউর রহমান।
তিনি বলেন, গলাকাটা অবস্থায় তার মৃতদেহ উদ্ধারের পর এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের যতগুলো সংস্থা আছে সবাই যৌথভাবে কাজ করেছে। আমরা শুরু থেকে এই মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে মনে করে তদন্ত শুরু করি। এইজন্য হত্যাকাণ্ডের মোটিভ উদঘাটন করার চেষ্টা করেছিলাম। আমরা ভেবেছি হয়তো মার্ডার পর গেইন আবার কখনও ভেবেছি রিলেশনের কারণে আবার কখনও ভেবেছি হয়তো মাদকাসক্ত থেকে কিংবা ছিনতাইকারীরা এমনটি করে থাকতে পারে।
কিন্তু তার মরদেহ উদ্ধার করার সময় তার পকেটে থাকা মানিব্যাগে প্রায় ৯শ’ টাকা পাওয়া যায় নগদ এবং একটা ভিভো মোবাইল পাওয়া যায়। যে কোনো ছিনতাইকারীর জন্য এই ৯শ’ টাকা এবং ১০-১৫ হাজার টাকার মোবাইল যথেষ্ট লাভের বিষয়। কিন্তু কেউ এগুলো নেয়নি। এতে বুঝা গেল কেউ মার্ডার ফর গেইনের জন্য এটা করেনি তা স্পষ্ট”- বলেন ডিসি মশিউর রহমান।
তিনি বলেন, ‘ডিজিটালি এবং এনালগ পদ্ধতিতে তার ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবন আমরা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখেছি। এখানেও স্পষ্ট যে তার কোনো শত্রু নাই। সে একজন নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন। কম কথার মানুষ ছিলেন। তার তেমন বন্ধুও নেই কোনো শত্রু ও নেই। যে কারণে আমরা দেখেছি যে- কেউ তাকে ডিজিটালি অনুসরণ করে নাই আবার ফিজিক্যালিও অনুসরণ করে নাই।’
তিনি বলেন, ‘তার মহাখালীর বাসা থেকে নিকেতনের হাতিরঝিল লেকের ধারে আসার পথে কেউ তাকে অনুসরণও করেনি। শতাধিক সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, সে একা একা উদ্দেশ্যহীনভাবে কখনও একই জায়গায় তিন চারবার আসা যাওয়া করেছে। এসব জায়গায় তাকে কেউ অনুসরণও করেনি। এ সময় সে কখনও অন্ধকার গলিতে হেঁটেছে আবার কখনও হেঁটেছে আলোকিত জায়গাতে। যদি তাকে কেউ মারতে চাইতো তাহলে অন্ধকার জায়গাতেই তাকে মেরে ফেলতে পারতো। এসব কিছু পর্যালোচনা এবং এ সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছি। কিন্তু কেউ এটার সঙ্গে জড়িত ছিল না।’
পরে আমরা প্রায় কয়েকশ সিসিটিভি ফুটজে চেক করেছি। তাতে আমরা দেখেছে সে বাসা থেকে বের হওয়ার পর গলির একটা দোকান থেকে মিষ্টি খেয়েছে। এরপর সেখান থেকে সামনে গিয়ে তিন-চারটা দোকানঘুরে একটা দোকান থেকে ২০ টাকা দিয়ে ফল কাটার ছুরি কিনেছে। সেই ছুরি কেনার পর তিনি রাস্তা পার হয়ে গাউছুল আজম মসজিদে কিছু সময় কাটান। এরপর গুলশান লেক পাড় থেকে হেঁটে হেঁটে নিকেতনের লেকপাড়ে আসেন। এরপর যেখানে তার মৃতদেহ পড়েছিল সেখানে সিসি ক্যামেরা ছিল না বিধায় বাকিটা স্পষ্ট হওয়া যায়নি। তবে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে হীনমন্যতার কারণে নিজেই নিচের গলায় ছুড়ি চালিয়ে সে।
ডিবির ডিসি বলেন, ‘আমরা তার ব্যক্তিগত জীবন বিশ্লেষণ করে দেখেছি, সে অত্যন্ত নিভৃতচারী একজন মানুষ ছিলেন। তার তেমন বন্ধু বান্ধব নেই। আমরা তার মোবাইলের কল লিস্ট এবং এসএমএস লিস্ট চেক করেছি। তাতে দেখা গেছে- সে সাত দিন-দশ দিনে একবার মোবাইলে কথা বলতো। এসএমএসেও তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি অপারেটরদের বিভিন্ন অফারের মেসেজ ছাড়া। তার কোনো ধরণের প্রেম ভালোবাসা কিংবা পরকীয়ার মতো এসব কোনো ঘটনাও পাওয়া যায়নি। এমনকি কোনো মাদক কিংবা কোনো জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত হওয়া বা কোনো ব্যক্তির সঙ্গে দেনা পাওনার হিসাব নিয়ে ঝামেলা এমন কোনো প্রমান মিলেনি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে সে একজন সরল-সোজা নিভৃতচারি মানুষ ছিলো। চরম নিসঙ্গ একজন মানুষ ছিল। ’
তিনি বলেন, ‘আমরা তার কিছু শারীরিক সমস্যার প্রেসক্রিপশন পেয়েছিলাম। তার চোখের সমস্যা ছিল। তার আত্মীয়রা বলেছেন- তার প্রচন্ড মাথা ব্যথায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলতো সে।’
তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর কিছুদিন আগে সে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দিয়েছিল এবং যে মেসে থাকতো সেখানেও মেস ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দিয়েছিল। এসব কিছু থেকে মনে হচ্ছে সে ছিল খুবই হতাশাগ্রস্থ। এ কারণে আমরা মনে করি এটি হত্যা নয়, বরং সুইসাইড হতে পারে। কারণ ঘটনাস্থলে যে ছুরি পাওয়া গেছে সেটি সে নিজেই কিনেছিল। এমন প্রমাণ আমরা পেয়েছি। তবে প্রাথমিকভাবে আমরা এটিকে সুইসাইড মনে করলেও এখনও ফরেনসিক রিপোর্টগুলো নিয়ে কাজ করতেছি। ফরেনসিক রিপোর্ট এবং মেডিকেল রিপোর্ট পেলে এটি আরও নিশ্চিত হওয়া যাবে।’