রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক নানা পরিস্থিতির কারণে বহির্বিশ্বের বহু দেশের মতো বাংলাদেশেও ডলারের রিজার্ভ কমছে। তাই ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন স্থগিত রাখার মাধ্যমে জ্বালানি তেল আমদানির খরচ কমাতে চেষ্টা করছে সরকার। তারই পরিপেক্ষিতে গত মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) থেকে দেশে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং শুরু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নৌ-প্রটোকল চুক্তির আওতায় গত শনিবার (২৩ জুলাই) প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে ২৫ লাখ লিটার (১,৮৬২ মেট্রিক টন) অপরিশোধিত জ্বালানি তেল দেশে এসে পৌঁছেছে। সংকটকালে জ্বালানি তেল পাওয়াকে স্বস্তিদায়ক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত বছর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে ১৬ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি তেল আমদানির অনুমতি পায় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাকুয়া রিফাইনারি লিমিটেড। তারই অংশ হিসেবে প্রথম চালানে ২৫ লাখ লিটার অপরিশোধিত তেল নরসিংদীর ঘোড়াশাল বন্দরে পৌঁছায়।
তেলবাহী জাহাজটি গত ৯ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া বন্দর থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। শনিবার সকালে ভারতীয় হাইকমিশনার, আমদানিকারক অ্যাকুয়া রিফাইনারি ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে পণ্য খালাস শুরু হয়।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
চলমান সংকটের মধ্যে তেল আমদানির খবরকে স্বস্তিদায়ক হিসেবে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ আকাশ। সময় নিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, সংকটের মধ্যে জ্বালানি তেল এসেছে, এটা অবশ্যই ভালো খবর। কিন্তু এই জ্বালানি তেল কী শর্তে আনা হয়েছে, বিশ্ববাজারের তুলনায় কেমন দামে আনা হয়েছে, এটি কি একটি চালানই এসেছে নাকি আরও আসবে, ভারত থেকে না এনে অন্য কোনো দেশ থেকে আনার সুযোগ ছিল কি না সেটাও জানা জরুরি। এরপরই এই তেল কোন খাতে ব্যবহার করা হবে সেটাও পরিকল্পনা করা দরকার।
তিনি বলেন, আমি তো মনে করি এই তেল কৃষি এবং রফতানিমুখী শিল্পখাতে ব্যবহার করা উচিত। তাতে দেশে খাদ্য উৎপাদন হবে, বৈশ্বিক খাদ্য সংকট ও খাদ্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির পরিস্থিতিতে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা আরও মজবুত হবে। অন্যদিকে রফতানিমুখী শিল্পখাতে ব্যবহার করা হলে এর মাধ্যমে আমরা ডলার পাব। তাতে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো থাকবে।
‘আসলে কোন খাতে তেল ব্যবহার করা হবে, তার ওপরই নির্ভর করবে আমদানিকৃত তেলের কতটা সুফল দেশের মানুষ পাবে,’ যোগ করেন এম এ আকাশ।
ভারত থেকে তেল আমদানিতে খরচ কম হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তবে সবমিলিয়ে এটি অবশ্যই ভালো যে দেশে তেল এসেছে। জ্বালানির মজুদ কিছুটা হলেও বেড়েছে।’
এদিকে, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম মনে করেন কোন দেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করছি সেটা বড় কথা নয় বরং কতটা কম দামে আনতে পারছি সেটাই জরুরি।
তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। এরমধ্যে আমদানি ব্যয় তথা ডলার সাশ্রয়ে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। ভারত থেকে তেল আমদানি করাই ভালো- ব্যাপারটা কিন্তু তেমন নয়। বরং এর মাধ্যমে কতটা ডলার সাশ্রয় হচ্ছে সেটিই বড় কথা।
তিনি বলেন, যত কম খরচে সম্ভব দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণ করা দরকার। আমরা এমনিতেই ডলার সংকটে আছি। যদি কম দামে আমরা আনতে পারি, সেটা কুয়েত বা ভারত যেখান থেকেই আসুক আমাদের জন্য ভালো। তবে ভারত থেকে আনলে পরিবহন খরচও কম হওয়ার কথা।
তিনি বলেন, তবে ডলার সাশ্রয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অযৌক্তিক ব্যয়, অনিয়ম, অস্বচ্ছতা বন্ধের কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি ভর্তুকি দিয়ে হলেও জ্বালানির পর্যাপ্ত আমদানি চালু রাখতে যেন ডলার বাঁচাতে গিয়ে উৎপাদন থমকে না যায়। তেমনটি হলে আরেকটি সংকট দেখা দেবে।
বাংলাদেশ কী সুবিধা পাবে
অন্য কোনো দেশ থেকে তেল আমদানি না করে ভারত থেকে তেল আনায় বাংলাদেশ কী সুবিধা পাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনের বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মাজহার আলম গণমাধ্যমকে বলেন, নৌ প্রটোকল চুক্তির আওতায় তেল আমদানি করায় অন্যান্য দেশ থেকে তেল আমদানির চেয়ে ভারত থেকে তেল আমদানিতে দাম কম পড়বে। এই চুক্তির আওতায় আরও ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন অপরিশোধিত তেল আগামী ১০ দিনের মধ্যে ভারত থেকে আমদানি হবে।
অন্যদিকে খালাস কার্যক্রম উদ্বোধনকালে এ্যাকোয়া রিফাইনারি লিমিটেডের পরিচালক ইরশাদ হোসেন জানান, এই তেল সরাসরি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কাছে যাবে। পরে পরিশোধিত হয়ে ভোক্তা পর্যায়ে যাবে। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এক সপ্তাহের মতো সময় লাগবে। আমদানিকৃত এই তেল শোধন করে ২৫ লাখ লিটার তেল বের করা হবে যার ৮০ ভাগ অকটেন ও ২০ ভাগ পেট্রোল। দেশে চলমান জ্বালানি সংকট নিরসনে এটি ভূমিকা রাখবে।
তিনি জানান, বর্তমানে ডলার সংকটের এই সময়ে, ভারতীয় রূপিতে এসব পেট্রোলিয়াম পণ্য কিনেছেন তারা। এর ফলে, অপেক্ষাকৃত কম দামেই জ্বালানি তেল সরবরাহ করা যাবে।
এরশাদ হোসেইন বলেন, আমরা যেখান থেকে আমদানি করছি সেখান থেকে তেল আসতে সর্বোচ্চ ৭-৮ দিন লাগে। সেখানকার দামও একটু কম। তাই এটা আমাদের জন্য চমৎকার একটু সুযোগ। আমরা ভারতে রুপিতে পেমেন্ট করতে পারব। ডলারের বর্তমানে যে ক্রাইসিস আছে তাই আমরা ডলারে না গিয়ে যদি ইন্ডিয়ান কারেন্সি করতে পারি তাহলে আমাদের দেশের জন্য অনেক ভালো হবে।