পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: এনডিটিভি
আগে থেকেই দুর্নীতির নানা অভিযোগ রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) বিরুদ্ধে। এরমধ্যেই শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সম্প্রতি দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) হাতে গ্রেফতার হয়েছেন রাজ্যটির সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এ নিয়ে চলছে তোলপাড়, সমালোচনার মুখে পার্থকে দলীয় সব পদ থেকে বরখাস্তের ঘোষণা দিয়েছে তৃণমূল। তবে সমালোচনা থামেনি। নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়েও।
গ্রেফতার হওয়ার পর ছয় দিনেও পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় অস্বস্তিতে পড়ে তৃণমূল, বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য তা অনেকটা অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। কারণ ২০২৪ সালের লোকসভার নির্বাচনে বিরোধী জোটের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চ্যালেঞ্জ করাসহ জাতীয় রাজনীতি নিয়ে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে। আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পার্থকাণ্ডই কাল হতে পারে মমতার জন্য।
দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি) বিশাল জয় এনে দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোদি ভারতের ন্যাশনাল কংগ্রেস (বর্তমান প্রধান বিরোধী দল) এবং তার সহযোগীদের দশক পুরোনো শাসনামলে অসহায়ভাবে ব্যাপক দুর্নীতির সাক্ষী হওয়া ভোটারদের কাছে টানতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ৮ বছর পূর্ণ করেছেন নরেন্দ্র মোদি। এই সময়ের মধ্যে বিরোধীরা দুর্নীতির নানা অভিযোগ এনে ‘ইস্যু তৈরির’ সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও, এখন পর্যন্ত মোদি বা তার সরকারের ওপর এর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।
তবে জাতীয় রাজনীতি থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি কিছুটা আলাদা। কারণ সেখানে আবেগের সামনে পিছিয়ে পড়ে যুক্তিবাদীতা। এর বড় উদাহরণ ২০২১ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন। বহুল আলোচিত সারদা কেলেঙ্কারিতে সরাসরি মমতা ও তার ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজন সহযোগীর নাম আসলেও বিধানসভা নির্বাচনে বড় জয় পায় টিএমসি।
অর্থপাচার মামলায় দুই মাস জেলে ছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির নেতা সত্যেন্দ্র জৈন। একই ধরনের আরেক মামলায় ইডির হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর চার মাস জেলে ছিলেন মহারাষ্ট্রের এনসিপি নেতা নওয়াব মালিক। তবে জেলে থাকা সত্ত্বেও তারা কেউই সেসময় মন্ত্রিত্ব হারাননি। তবে সম্প্রতি মহা আঘাদি জোট সরকারের পতনের পর মন্ত্রীর চেয়ার হারান নওয়াব মালিক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা বহাল রাখার সুযোগ ছিল পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সামনেও।
তবে মমতা ভালো করেই জানতেন যে এই সংকট জিয়িয়ে রেখে মোদির সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে বিকল্প প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করা কঠিন হবে তার জন্য।
ইডি এখন পর্যন্ত পাঁচ কেজি সোনার পাশাপাশি পার্থ ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী অর্পিতা মুখার্জির দুটি ফ্ল্যাট থেকে নগদ প্রায় ৫০ কোটি রুপি উদ্ধার করেছে। বিজেপি বলছে, মোট উদ্ধার হওয়া সম্পদের পরিমাণ ২০০ কোটি রুপির বেশি, যার মধ্যে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দিয়ে কেনা কিছু অস্থাবর সম্পত্তিও রয়েছে।
প্রসঙ্গত, কয়লা কেলেঙ্কারির এক মামলায় বর্তমানে ইডির নজরদারিতে আছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাগ্নে ও তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার স্ত্রী।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পার্থের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দুর্নীতির কেলেঙ্কারি থেকে মুক্তি পাবেন এমন কিছু ভেবে থাকলে তা হবে মমতার বড় ভুল। কারণ পার্থকে মন্ত্রী এবং দলীয় পদ থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিতে কেন মমতার ছয় দিন সময় লাগল, তা নিয়ে এরইমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।
এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি উঠছে তা হলো, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি এতটাই ‘বোকা’ যে তিনি জানতেনই না পার্থকে টাকা দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ করছে তৃণমূল সরকার!
অনেকে মনে করেন, এখন পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া নগদ অর্থ এবং সোনা কিছুই নয়। এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রাখা হতে পারে। এটা কল্পনা করা কঠিন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে লুকিয়ে বা তার কৌশলগত অনুমোদন ছাড়াই এ ধরনের বড় দুর্নীতি হতে পারে। কারণ পাঁচ বছর ধরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর এখন ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন মমতা।
বিশ্লেষকদের মতে, মমতার নেতৃত্বের মানের ভিত্তিতে বিষয়টিকে দুদিক থেকে বিবেচনা করা যায়। প্রথমত, তিনি যদি আগে থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আর্থিক কেলেঙ্কারি সম্পর্কে অবগত না হয়ে থাকেন তাহলে এটি এক অর্থে নেতা হিসেবে তার অক্ষমতা। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি যদি তার অনুমোদনে ঘটে থাকে তাহলে সেটিই মমতার প্রধানমন্ত্রিত্বের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে ম্লান করার জন্য যথেষ্ট হতে পারে।
শুধু তাই নয়, বিরোধী জোটের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেও অনেক বাধা অতিক্রম করতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কারণ একই উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে তার সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে আছেন কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী, এনসিপির শারদ পাওয়ার, তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো বড় নেতারা।
ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধীদের সর্বসম্মত পছন্দ হিসেবে গৃহীত হবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে একজন নেতা হিসেবে মমতার গ্রহণযোগ্যতা এবং জনগণকে এটি বিশ্বাস করানো যে জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তিনিই সেরা। যেমনটি মোদি করেছিলেন ২০১৪ সালে।
এছাড়া সারদা কেলেঙ্কারি বা শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির মতো ঘটনা যদি মমতার অনুমোদনে হয়ে থাকে, তাহলে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে যে এরচেয়ে বড় দুর্নীতি হবে না তার নিশ্চয়তা কী? এখন এমনই প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা, বিশেষ করে বিজেপি নেতারা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায় কিছুদিন হয়তো জেলে থাকবেন। এমনকি দোষীও সাব্যস্ত হতে পারেন। কিন্তু তার ‘টাকার বিনিময়ে চাকরি’ কেলেঙ্কারি যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বড় ধাক্কা হয়ে আসবে সেটি প্রায় নিশ্চিত।