ঢাকা থেকে ভোলাগামী গ্রীনলাইন-৩ লঞ্চে কথিত ‘জিনের বাদশা’ ওরফে জাকির হোসেন বাচ্চু নামের এক যুবককে হত্যার ঘটনায় তার সাবেক স্ত্রী আরজু আক্তারকে (২৩) গ্রেফতার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মঙ্গলবার (২ আগস্ট) ভোরে ঢাকার সাভারের নবীনগর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার আরজু আক্তার (২৩) বোরহানউদ্দিন থানার চরটিকটা গ্রামের মৃত হাফিজ উদ্দিনের মেয়ে। খুন হওয়া জাকির হোসেন বাচ্চু ও একই থানার পূর্ব মহিষখালি গ্রামের ফরাজি বাড়ির মো. সিদ্দিক ফরাজির ছেলে।
পিবিআই বলছে- প্রথম স্ত্রী থাকা সত্বেও আরজু আক্তারের সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্ক গড়ে উঠে বাচ্চুর। এক পর্যায়ে আরজুকে বিয়ে করেন তিনি। কিন্তু আরজুকে বিয়ের পরও একাধিক নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত হন তিনি। এতে ক্ষিপ্ত হন আরজু। মনে মনে পরিকল্পনা করতে থাকেন কিভাবে শাস্তি দেওয়া যায় বাচ্চুকে। এই পরিকল্পনা থেকে খুন করেন আরজু।
বুধবার (০৩ আগস্ট) দুপুরে ধানমন্ডিতে পিবিআই হেডকোয়ার্টার্সে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআইয়ের ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ খোরশেদ আলম।
তিনি বলেন, ‘গত ৩১ জুলাই জাকির হোসেনের প্রথম স্ত্রী সুরমা আক্তার বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, জাকির ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের দিকে স্ত্রী আরজু বেগমকে বিয়ে করেন। দ্বিতীয় বিয়ের পর জাকির কিছুদিন তার দ্বিতীয় স্ত্রী আরজুর সঙ্গে বসবাস করেন এবং এক পর্যায়ে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের দিকে আরজু বেগমকে ডিভোর্স দেন।
কাজের সুবাদে জাকির বড় ভাইয়ের স্ত্রী মিনারার (৩০) বাসায় থাকতেন। গত ২৯ জুলাই সকাল ৭টার দিকে জাকির লঞ্চে করে বাড়িতে আসবে বলে জানান। পরে ওইদিন তাকে বার বার ফোন দিলেও তার নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। ঠিক সময়ে বাড়িতে না আসায় প্রথম স্ত্রীর সন্দেহ হয় এবং তিনি স্বজনদের জানান।
পরে তাকে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করলে একপর্যায়ে সদরঘাট নৌ থানা জানায়, গত ২৯ জুলাই রাত ৮টা ১০ মিনিটের দিকে সদরঘাটে থাকা এমভি গ্রিন লাইন-৩ লঞ্চের ৩য় তলার মাস্টার কেবিনের ভেতরে খাটের নিচে জাকিরের মরদেহ পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও লঞ্চের কয়েকজন স্টাফের মাধ্যমে তার প্রথম স্ত্রী জানতে পারেন, লঞ্চের কেবিনে তার স্বামীর সঙ্গে কফি কালারের বোরকা পরা মুখ ঢাকাবস্থায় একটি নারী ছিলেন। তার স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে আর কোথাও দেখা যায়নি।
আসামি আরজুর বরাতে এসপি খোরশেদ আলম বলেন, ‘জাকির হোসেন বাচ্চু দুই বছর আগে জিনের বাদশা পরিচয়ে আরজু আক্তারকে ফোন দেন। তার পর থেকে আরজু আক্তারের সঙ্গে পরিচয়, প্রেম ও পরবর্তীতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। জাকির হোসেন বাচ্চু আসামি আরজু আক্তারকে জিনের বাদশা প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে এবং তাকেও এ কাজে পারদর্শী করে তোলেন।’
তিনি বলেন, ‘আরজুর সঙ্গে বিয়ের পরও একাধিক নারীর সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়েন জাকির । জিনের বাদশার পরিচয়ে প্রতারণার মাধ্যমে জাকির যে অর্থ উপার্জন করতেন তা অনৈতিক কাজে খরচ করতেন। এসব বিষয় নিয়ে আরজুর সঙ্গে জাকিরের ব্যাপক মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। তাই গত প্রায় ৫ মাস আগে দ্বিতীয় স্ত্রী আরজু আক্তারকে তালাক দেন জাকির।
কিন্তু তালাক দেওয়ার পরও দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতো জাকির। আবার একাধিক নারীর সঙ্গেও পরকীয়া করতো জাকির। বিষয়টি আরজুর কাছে ধরা পড়ে। এতে আরজু আক্তার আরও বেশি ক্ষিপ্ত হন এবং জাকির হোসেন বাচ্চুকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন।’
এসপি বলেন, ‘মামলার ঘটনার আগের দিন রাতে জাকির তার এক পরকীয়া প্রেমিকার সঙ্গে রাত যাপন করেন। বিষয়টি আরজু আক্তার বুঝতে পারেন। এরপর হত্যার ঘটনার দিন ২৯ জুলাই জাকিরের ঢাকা থেকে লঞ্চে গ্রামের বাড়ি ভোলা যাওয়ার বিষয়টি আরজু জানতে পারেন। এরপর আরজু জাকিরকে লঞ্চের একটি কেবিন ভাড়া করে তাকেও বাড়ি নিয়ে যেতে বলেন।
জাকির ও আরজুর বাড়ি একই এলাকায় পাশাপাশি গ্রামে হওয়ায় তিনি ঢাকা থেকে ভোলাগামী এমভি গ্রিন লাইন-৩ লঞ্চের একটি স্টাফ কেবিন ভাড়া নেন। ভাড়া নেয়ার সময় তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে লঞ্চে ওঠেন। কেবিন ভাড়া নেয়ার সময় লঞ্চ কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য রাখেনি। লঞ্চে ওঠা থেকে নামা পর্যন্ত আসামি আরজু বোরকা পরে মুখ ঢেকে রেখেছিলেন।’
পিবিআইয়ের এসপি বলেন, ‘শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে তারা সদরঘাট থেকে ভোলার ইলিশা যাওয়ার জন্য লঞ্চে ওঠেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আরজু দুধের সঙ্গে ৫টি ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে লঞ্চে ওঠেন। আর জাকির এক বাটি রসমালাই কেনেন। লঞ্চে ওঠার ঘণ্টা খানেক পর আরজু ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত দুধ জাকিরকে খাইয়ে দেন। দুধ খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে জাকির অচেতন হয়ে গেলে ওড়না দিয়ে তার হাত এবং পা বেঁধে ফেলেন। পরে অন্য একটি ওড়না দিয়ে জাকিরকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন।
হত্যার পর জাকিরের মরদেহ কেবিনের স্টিলের খাটের নিচে লুকিয়ে রাখেন। লঞ্চটি ভোলার ইলিশা ঘাটে পৌঁছালে আরজু নেমে যান। ওইদিন দুপুর আড়াইটার দিকে লঞ্চটি ইলিশা থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়। লঞ্চের স্টাফরা ওই কেবিনটি তিন জন বাচ্চাসহ দুইজন নারীকে ভাড়া দেন। লঞ্চটি ঘাট ছেড়ে আসার প্রায় দুই ঘণ্টা পর তাদের সঙ্গে থাকা একটি বাচ্চা খাটের নিচে গেলে একজন নারী খাটের নিচ থেকে বাচ্চাটিকে আনার সময় মরদেহ দেখে চিৎকার শুরু করেন। এ সময় লঞ্চের স্টাফদের নজরে আসে।
লঞ্চ কর্তৃপক্ষ সদরঘাট এসে বিষয়টি ঢাকা সদরঘাট নৌ থানা পুলিশকে জানালে তারা অজ্ঞাত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তের জন্য পিবিআইকে অবহিত করে। পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের ক্রাইমসিন টিম জাকির হোসেন বাচ্চুর পরিচয় শনাক্তের পর বিষয়টি পিবিআই ঢাকা জেলা পুলিশকে অবহিত করে।
পিবিআইয়ের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। পরে গত ৩১ জুলাই জাকিরের ১ম স্ত্রী সুরমা আক্তার বাদী হয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলা নেয়ার ৪৮ ঘণ্টার আগেই আসামিকে গ্রেফতার করে পিবিআই ঢাকা জেলা।’