প্রতীকী ছবি১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বাঙালি জাতির জীবনে একটি কালো অধ্যায়। এদিন ঘাতকরা বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। একইদিন খুনিদের দিগ্বিদিক ছোড়া কামানের গোলায় নিহত হন মোহাম্মদপুরে শেরশাহ সুরী রোডের ১৩ জন। মামলার সাক্ষী না আসায় এখনো শেষ হয়নি এ মামলার বিচার। সাক্ষীদের বারবার সমন দেওয়ার পরও তারা সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত হচ্ছেন না। ফলে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ।
মোহাম্মদপুরের ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ২৫ বছর পর ১৯৯৬ সালে মামলা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী। মামলার পর ১৭ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। সাক্ষী করা হয় ৫৮ জনকে। ১৬ বছর আগে ১৭ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। মামলাটিতে ১৬ বছরে আদালতে সাক্ষ্য দেন ১৮ জন। সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে এ মামলায় পলাতক আসামিদের মধ্যে কোন কোন আসামির মৃত্যু হয়েছে তা চেয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপারকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়।
জেল সুপার ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর (বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায়, তারা এ মামলারও আসামি ছিলেন) হয়েছে বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। আগামী ২৩ আগস্ট মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম হেলাল বলেন, ২০২১ সালের ২ নভেম্বর মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখিত ১৭ আসামির মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোন কোন আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে এ বিষয়ে আদালতে আবেদন করি। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এ বিষয়ে জানার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সিনিয়র জেল সুপার ও মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। জেল সুপার এ বিষয় প্রতিবেদন দাখিল করেন। এছাড়া এ মামলায় সাক্ষীদের বারবার সমন দেওয়ার পরও সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হচ্ছেন না। সাক্ষী না আসায় মামলার বিচারিক কার্যক্রমও শেষ করতে পারছি না।
এ মামলার বাদী মোহাম্মদ আলী গত মারা যান। তার শেষ ইচ্ছা ছিল এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখে যাওয়া। কিন্তু তার শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়নি বলে জানান স্ত্রী শাহানাজ বেগম। তিনি বলেন, ‘গত বছর আমার স্বামী মারা গেছেন। ওনার এ মামলার বিচার দেখে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। উনি এ মামলার বিচারের জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন। নিজের যতটুকু সম্পদ ছিল সেটাও আর নেই। এখন দুই সন্তান নিয়ে নিরুপায় হয়ে জীবনযাপন করছি। তিনি তো চলে গেছেন। এখন এ মামলার বিচার দ্রুত শেষ করা হোক। আর আমার দুই সন্তান নিয়ে মাথাগোঁজার ব্যবস্থা করা হোক।’
মামলার নথি থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আক্রমণের সময় সেনা সদস্যরা কামানের গোলা ছুড়লে তা গিয়ে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডের ৮ ও ৯ এবং ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির (টিনশেড বস্তি) ওপর পড়ে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) ছোড়া কামানের গোলার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মুহূর্তে ধুলায় মিশে যায় ওই বস্তি। ওই ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ১৩ জন মারা যান। প্রায় ৪০ জন আহতের মধ্যে কয়েকজন সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেন।
নিহতরা হলেন রিজিয়া বেগম ও তার ছয় মাসের মেয়ে নাসিমা, কাশেদা বেগম, ছাবেরা বেগম, সাফিয়া খাতুন, আনোয়ারা বেগম (প্রথম), ময়ফুল বিবি, আনোয়ারা বেগম (দ্বিতীয়), হাবিবুর রহমান, আবদুল্লাহ, রফিজল, সাহাব উদ্দিন আহম্মেদ ও আমিন উদ্দিন আহম্মেদ।
ওই ঘটনায় ৮ নম্বর বাড়ির মালিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় এ মামলা করেন। ২০০১ সালের এপ্রিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সী আতিকুর রহমান। এরপর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
২০১৫ সালের ৭ মে মামলার বাদী মোহাম্মদ আলী সাক্ষ্য দেন। এর মাধ্যমে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সবশেষ ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মুন্সী আতিকুর রহমান আদালতে সাক্ষ্য দেন। মামলায় ৫৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৮ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে।
১৭ আসামি হলেন- লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, তাহের উদ্দিন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদ (পলাতক), লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম (পলাতক), লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী ইবি (পলাতক), লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আব্দুল মাজেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী (পলাতক), মেজর রাশেদ চৌধুরী (পলাতক), মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহম্মেদ, মেজর আহম্মদ শরিফুল হোসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম (পলাতক), ক্যাপ্টেন কিসমত হোসেন (পলাতক), ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার (পলাতক), রিসালদার (অব.) মোসলেহ উদ্দিন (পলাতক), দফাদার মারফ আলী শাহ (পলাতক) ও এলডি মোহাম্মদ আবুল হাসেম মৃধা (পলাতক)।
২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরা হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ। ওই পাঁচজন ছাড়া এ মামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে (প্রয়াত) গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল। ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদেরও ফাঁসি কার্যকর হয়। এছাড়া বাকি দশ আসামি এখনো পলাতক।