পাকিস্তানের কাছে হেরে এশিয়া কাপ থেকে বিদায় নিলেও এবারের টুর্নামেন্টে আফগানিস্তানের সাহসী ক্রিকেট মুগ্ধ করেছে সবাইকে। শূন্য থেকে অসীম উচ্চতায়। আফগান ক্রিকেট যেন রূপকথার সত্যি কোনো গল্প। যার পরতে পরতে দেশপ্রেম আর প্রচণ্ড মানসিক শক্তির বিচ্ছুরণ। তবে তাদের এমন বদলে যাওয়ার নেপথ্যে আছে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ অবদান। আলাদা করে বললে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি)। একাডেমি সুবিধা থেকে শুরু করে কোচ কিংবা পরামর্শক দিয়েও আফগান বোর্ডকে সবসময়ই সহায়তা করে পিসিবি। তাই তো মাঠের লড়াই ছাপিয়ে রশিদ-মুজিবদের সঙ্গেও দারুণ সম্পর্ক পাক ক্রিকেটারদের।
হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ডিপোজিট নেই, ঘরোয়া শক্ত কোনো ক্রিকেট কাঠামো নেই, স্পন্সর নেই, মাঠ নেই; তার চেয়ে ভীতিকর–জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, আকাশে-বাতাসে মিশে থাকা বারুদের গন্ধেও কোনোভাবে বেঁচে থাকা দেশটির নাম আফগানিস্তান। তবুও আফগানদের যা আছে, তা নিয়ে ইর্ষা হতেই পারে। শুধু রাশিদ-মুজিব-নবিই নন, এ দলটার আছে দেশের প্রতি প্রগাঢ় মমত্ববোধ, ইস্পাতদৃঢ় চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা, দায়িত্ব, আর হারার আগেই না-হারার মানসিকতা। চলতি এশিয়া কাপও দেখেছে তারই পূর্ণমঞ্চায়ন। তবে আফগানদের ক্রিকেটের এই উত্থানে পাকিস্তানের অবদান কোনো অংশেই কম নয়।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই আফগানিস্তানের অলি-গলিতে শুরু হয় ক্রিকেট। ১৯৯৫ সালে গঠিত হয় আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড। ইমরান-ইনজামাম-আকরামদের দেখে দেখেই আত্মবিশ্বাসের রসদ জোগায় তারা। যদিও আইসিসির স্বীকৃতি পেতে লেগে যায় আরও ছয় বছর।
তবে পরিস্থিতি পাল্টে যায় ২০০১ সালে। তখন আফগানজুড়ে ক্ষমতার পালাবদলের হাওয়া। ভীতিকর পরিস্থিতি আর তালেবান শাসনে দেশ ছাড়ছে মানুষ। অন্যসব খেলার মতোই নিষিদ্ধ হয় ক্রিকেটও। পাকিস্তানের উদ্বাস্তু শিবিরে তখন এই খেলাটির সঙ্গে পরিচয় বর্তমান দলের অধিকাংশের। যেখানে বাচ্চারা বন্দুক ফেলে তুলে নিয়েছিল ব্যাট। তৈরি হয়েছিল রূপকথার প্রথম অধ্যায়।
তালেবান নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে ২০০৩ সালে আসে এসিসির সদস্যপদ। তখন থেকেই বন্ধুর মতো তাদের পাশে ছিল পিসিবি। শুধু অর্থনৈতিক সহযোগিতাই নয়, কোচ কিংবা টেকনিক্যাল নানা পরামর্শ দিয়ে আফগান বোর্ডকে সাহায্যের হাত বাড়ায় তারা। আফগানিস্তানের একমাত্র হাই পারফরম্যান্স একাডেমিও লাহোরে অবস্থিত।
পাক টিভির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সানাউল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, ‘আফগানিস্তানের অধিকাংশ ক্রিকেটারই একসময় পেশোয়ারে বাস করত। তারা পাকিস্তানের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। এ নিয়ে পিসিবিও কখনোই অমত করেনি; বরং ভাই কিংবা বন্ধু হিসেবে সবসময়ই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই যে আফগানিস্তান বর্তমানে এত ভালো ক্রিকেট খেলছে, এটা দেখে আমাদেরও ভালোলাগা কাজ করে।’
২০১০ সালে প্রথমবারের মতো আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বিশ্বকে চমকে দেয় রুমির দেশ। তখনও দেশটিতে শুরু হয়নি ঘরোয়া ক্রিকেট। পাকিস্তানেও নিষিদ্ধ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় আফগানিস্তান। আমিরাতের পাশাপাশি পাকিস্তানকে তারা ব্যবহার করে হোম ভেন্যু হিসেবে।
আফগানদের সোনালি প্রজন্মের ক্রিকেটার রাশিদ খান, জাজাই, মুজিব, জান্নাত, রহমত সবারই ক্রিকেটের হাতেখড়ি পাকিস্তানে। স্পিনের সঙ্গে তাদের পেস বোলিং বদলে দেয়ার নায়ক পাকিস্তানি পেসার উমর গুল।
সানাউল্লাহ বলেন, ‘উমর গুলকে বলা হয় সুইং মাস্টার। লক্ষ করবেন, সে দায়িত্ব নেয়ার পর তাদের পেস বোলিংও আমূল বদলে গেছে। ফারুকি, ওমরজানি সবাই গুলের তালিম ভালোভাবেই নিতে পেরেছে। জেনে অবাক হবেন, এখনো আফগান ক্রিকেটার অন্বেষণ ক্যাম্প পাকিস্তানে হয়।’
এমনকি আফগান ক্রিকেটার অগ্রজ নওরোজ মঙ্গল, আজগর সবার ক্রিকেটার হয়েছেন পাকিস্তানে থেকেই। তাই তো পাকদের সহযোগিতায় আর কিছু না থেকেও আফগান ক্রিকেট যখন এগিয়ে যাওয়ার গল্প লেখে, তখন সব থেকেও আমরা খুঁজি পায়ের তলায় মাটি।