ছবি: এএফপি
মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থি বিদ্রোহী এবং তাদের সহযোগীদের ওপর সামরিক সরকারের হামলায় বেসামরিক হতাহতের ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে গত মাসের শেষে দিকে দেশটির সাগাইং অঞ্চলে জান্তা বাহিনীর হামলার পর নতুন করে সংঘাতের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সাগাইংয়ে জান্তা সেনাদের প্রতিশোধমূলক এ আক্রমণের পর সম্প্রতি অঞ্চলটির ধ্বংসযজ্ঞ চালানো এক গ্রামে টহল দিয়েছে মিয়ানমারের অভ্যুত্থানবিরোধী যোদ্ধারা। তারা বলছেন, সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর উত্তর-পশ্চিম সাগাইংয়ের এ গ্রামটিতে প্রচণ্ড লড়াই হয়েছে। যেটি এখন প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
বার্তা সংস্থা এএফপির সংগ্রহ করা এক বিরল ফুটেজেও দেখা গেছে অঞ্চলটির সহিংসতার চিত্র। যেখানে জান্তা বাহিনী, সামরিকপন্থি মিলিশিয়া এবং অভ্যুত্থানবিরোধী যোদ্ধারা সংঘাতে লিপ্ত।
এ ছাড়া কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে অঞ্চলটির ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ করে দেয় বলে জানা গেছে।
উইন সো নামে এক বাসিন্দার উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মাসের শেষের দিকে মিয়ানমারের দ্বিতীয় বড় শহর মান্দালে থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত থারিয়ারকোন গ্রাম ধ্বংসযজ্ঞ চালায় জান্তা সেনারা।
তিনি বলেন, ‘সৈন্যরা তাদের ক্যাম্পে ফেরার পথে আমাদের গ্রামে এসেছিল। এখানে কোনো যুদ্ধ হয়নি। তারা কেবল সবকিছু ধ্বংস করতে এসেছিল। তারা আমাদের গ্রামের ৬০টি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে।’
জানা যায়, এ ঘটনার পর টহল দেয়ার সময় গ্রামের পুড়ে যাওয়া অবশিষ্টাংশগুলো জরিপ করতে গিয়েছিল অন্তত ১২ জন যুবকের একটি দল। যারা স্থানীয় পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) সদস্য। অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে উৎখাতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছে এই পিডিএফ।
কিছু বিশ্লেষকের মতে, কম সক্ষমতা সত্ত্বেও পিডিএফের বিভিন্ন গ্রুপের অব্যাহত আক্রমণ অবাক করেছে সামরিক বাহিনীকেও। আর এর আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়ায় গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করা, বিচারবহির্ভূত গণহত্যা এবং বেসামরিকদের ওপর বিমান হামলার মতো নারকীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে জান্তা সরকার।
গত মে মাসে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে ১২ হাজারের বেশি বেসামরিক সম্পত্তি পুড়িয়ে বা ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
যদিও পিডিএফ যোদ্ধাদের ‘সন্ত্রাসী’ ঘোষণা করে আগুন লাগানোর জন্য তাদের অভিযুক্ত করছে সামরিক বাহিনী। এমনকি দেশে বৌদ্ধ ভিক্ষু, শিক্ষক এবং চিকিৎসা কর্মীসহ শত শত মানুষকে হত্যায় পিডিএফ সদস্যরা জড়িত বলেও দাবি জান্তার।
বাস্তুচ্যুত লাখো মানুষ
জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, দীর্ঘস্থায়ী জাতিগত দ্বন্দ্বের কারণে সীমান্ত এলাকার পাশাপাশি অভ্যুত্থান-পরবর্তী সহিংসতায় মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১০ লাখের বেশি।
জাতিসংঘ বলছে, বেশিরভাগ জাতিগত বামারের আবাসস্থল এবং সেনাবাহিনীর জন্য একটি ঐতিহ্যগত নিয়োগের ক্ষেত্র সাগাইংয়ে অভ্যুত্থানের পর থেকে ৫ লাখেরও বেশি লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
মিয়ানমারের রক্তক্ষয়ী অচলাবস্থা সমাধানের জন্য জাতিসংঘ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর বিভিন্ন সংস্থার নেতৃত্বে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার তেমন কোনো অগ্রগতিও হয়নি।
জান্তাবিরোধী এক পিডিএফ সদস্য বলেন, ‘আমরা এক বছর ধরে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। কিন্তু আমাদের কাছে পর্যাপ্ত অস্ত্র নেই এবং আমরা কেবল আমাদের ঘরে তৈরি বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করছি। যখন সৈন্যরা আমাদের গ্রামে আসে, আমরা গ্রামবাসীদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য সতর্ক করি এবং আমরা তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। সেনারা গ্রামের কোনো বাসিন্দাকে ধরে নিয়ে গেলে, তাদের অধিকাংশই আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেন না।’
এদিকে রাশিয়া সফরে গিয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর দেশটির বার্তা সংস্থা আরআইএকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পশ্চিমাদের দিকে আঙুল তুলে জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং বলেন, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে পশ্চিমারা।
যদিও মিয়ানমারের সংকট এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে দাবি করেন জান্তাপ্রধান। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী বছর দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন আয়োজনে যা যা করা দরকার, সামরিক সরকার তা-ই করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে অং সান সুচির সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে নেয় দেশটির সামরিক বাহিনী। এরপর থেকেই মিয়ানমারজুড়ে শুরু হয় বিক্ষোভ। আর সেই বিক্ষোভ দমনে সামরিক বাহিনী একদিকে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে, অন্যদিকে গণহারে গ্রেফতার করেছে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের। তবে এখনও রাশিয়া এবং চীনের মতো ক্ষমতাধর দেশের সমর্থন পেয়ে আসছে জান্তা সরকার।