প্রায় ৮৯টি উৎসের কারণে মারাত্মক দূষণের কবলে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের হৃৎপিণ্ডখ্যাত কর্ণফুলী নদী। এতে নদীর দু’পাশের বিপন্ন ৮১টিসহ মোট ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ হুমকির মুখে বলে সম্প্রতি পরিবেশবাদী সংগঠন ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান অপিনিয়ন (ইকো)-এর এক গবেষণায় তথ্য উঠে এসেছে।
প্রায় আট মাস ধরে করা এ গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি দূষণ বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কালুরঘাট অংশে। যার কারণে এসব এলাকায় উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা অনেক কম। যদি দূষণসহ দখল বন্ধ না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এই প্রজাতিগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
ইকোর সহযোগিতায় এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত পরিচালিত হওয়া গবেষণাটির নেতৃত্ব দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল। সহযোগী হিসেবে নেতৃত্বে ছিলেন ইকোর সায়েন্টিফিক কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক ও বর্তমান ছাত্ররা।
গবেষণা নিয়ে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল বলেন, গবেষণায় কর্ণফুলী নদীর দু’পাশে মোট ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত করা হয়েছে, যা ৩৭৩টি গণভুক্ত এবং ১১৩টি পরিবারের অন্তর্গত। এ গবেষণায় শনাক্ত হওয়া গাছের মধ্যে মোট ৩৫৫টি ঔষধি উদ্ভিদ। এর মধ্যে ৮১টি বিপন্ন প্রজাতির।
তিনি আরও বলেন, কর্ণফুলী বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের প্রাণ। এই নদীর ওপর দেশের অর্থনীতি নির্ভরশীল, কিন্তু ক্রমেই এ নদী অসুস্থ হয়ে পড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগর মোহনা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত প্রায় ৮৯টি উৎস নদী দূষণের জন্য দায়ী। এর মধ্যে ৫৩টি শিল্পকারখানা, ১৪টি নৌযান মেরামতের জায়গাসহ বাজার নালা, খামার, শুঁটকি পল্লিও অন্তর্ভুক্ত। অধিকাংশ উৎস সাগরের মোহনা থেকে কালুরঘাট ব্রিজ পর্যন্ত জায়গায় অবস্থিত।
প্রাথমিকভাবে এ গবেষণায় কর্ণফুলী দূষণের ৩০টি কারণ শনাক্ত করার কথা উল্লেখ করে ইকোর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এস এম আবু ইউসুফ সোহেল বলেন, গবেষণার সময় নদীর দুই তীরে অবস্থিত বিভিন্ন কলকারখানা থেকে নদীতে নির্গত বর্জ্য পদার্থ সংগ্রহ করে ল্যাবে বিশ্লেষণ করে মানবদেহ ও প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি শনাক্ত করি। এগুলোর মধ্যে অত্যধিক ক্ষারকীয় দ্রবণ, দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ, ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগর মোহনা থেকে কালুঘাটের পর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দূষণ, নদী দখল, বর্জ্য পদার্থ ও শহরের ড্রেনের দূষিত পানির মিশ্রণ দেখা গেছে। যার কারণে এই এলাকায় উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা অনেক কম এবং যেগুলো এখনও টিকে আছে, যদি দূষণসহ দখল বন্ধ না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এই প্রজাতিগুলো হারিয়ে যাবে। তাছাড়া কর্ণফুলীতে দূষণ হলে হালদা নদী দূষিত হবে। গবেষণায় ডলফিনের আধিক্য সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে শিকলবাহা ও বোয়ালখালী চ্যানেলে। দূষণ বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে ডলফিনের স্বাভাবিক চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে এবং একসময় বিলুপ্ত হবে ডলফিন।
এস এম আবু ইউসুফ আরও বলেন, নদী দখল ও দূষণ বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে ইকোর গবেষণায় শনাক্ত হওয়া ৮১টি প্রজাতির বিপন্ন উদ্ভিদসহ মোট শনাক্ত ৫২৮টি উদ্ভিদের মধ্যে অনেক উদ্ভিদ হারিয়ে যাবে। যা নদীর তথা চট্টগ্রাম শহরের পরিবেশ বিনষ্ট করবে। এছাড়াও দূষণ বন্ধ না হলে ডলফিনসহ বিভিন্ন প্রাণী বিলুপ্ত হবে। নদীতে বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণের ফলে দৈনন্দিন কাজে নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে, যা থেকে চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টসহ ক্যানসার হতে পারে বলেও জানান এ পরিবেশবিদ।