ছবি: সংগৃহীত
নাটকীয় এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সরকারকে উৎখাত করে প্রায় ২০ মাস আগে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক জান্তা। কিন্তু মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তারা অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যেমন ব্যর্থ হয়েছেন, তেমনি দিন দিন বেসামরিক জনগণের ওপর তাদের নৃশংসতার মাত্রাও বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই নিজ দেশের সাধারণ মানুষের ওপরও চড়াও হচ্ছে সামরিক জান্তা। এর ফলে মূলত মিয়ানমারের ওপর নিজেদের দখল হারাচ্ছে জান্তা সরকার।
মিয়ানমারজুড়ে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) এবং জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতিরোধের সামনে প্রায় নিয়মিত মুখ থুবড়ে পড়ছে দেশটির সেনাবাহিনী। এর ফলে সামরিক জান্তা আরও মরিয়া হয়ে উঠছে এবং বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক নৃশংসতা চালাচ্ছে।
বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুসারে, অভ্যুত্থানের পর জান্তার হাতে এখন পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। গ্রেফতার বা আটক করা হয়েছে ১৫ হাজারের বেশি মানুষকে।
দেশের বেশির ভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। স্পেশাল অ্যাডভাইজরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমারের (এসএসি-এম) তথ্য বলছে, দেশটির মাত্র ১৭ শতাংশ অঞ্চলের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আছে জান্তার। অভ্যুত্থানের পাল্টা প্রতিবাদ হিসেবে গঠিত ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) নামের ছায়া সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে ৫২ শতাংশ এলাকা। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অবস্থানে আছে বাকি অঞ্চলগুলো। দেশের ৩৩০টি শহরাঞ্চলের মধ্যে মাত্র ৭২টিতে ‘স্থিতিশীল নিয়ন্ত্রণ’ রয়েছে সেনাবাহিনীর।
এ ছাড়া প্রতিনিয়ত হতাহত বাড়তে থাকা, নতুন নিয়োগে স্থবিরতা এবং পক্ষত্যাগের কারণে নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা আনুমানিক ৪ লাখ থেকে কমে নেমে এসেছে প্রায় ২ লাখে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দলত্যাগকারীরা যে মাত্রায় গণতন্ত্রপন্থি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে, তা মিয়ানমারের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এর থেকে স্পষ্ট যে, তাতমাদোখ্যাত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বৈধতা এবং অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের বিষয়টি এখন গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে।
এনইউজি বলছে, অভ্যুত্থানের পর থেকে ৮ হাজারেরও বেশি সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা দলত্যাগ করেছেন। এ ছাড়া বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন রয়েছে যে, সামরিক জান্তা এখন পিপলস সিকিউরিটি ফোর্স-পিএসএফের মতো বিভিন্ন প্রক্সি গ্রুপের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
পিডিএফ-এর সামরিক সক্ষমতার উল্লেখযোগ্য উন্নতি সংঘাতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। প্রতিরোধ যোদ্ধারা, যারা একসময় কেবল বাড়িতে তৈরি বন্দুকের ওপর নির্ভরশীল ছিল; তারা এখন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের পাশাপাশি ল্যান্ডমাইন এবং ড্রোনের মতো অত্যাধুনিক হার্ডওয়্যার ব্যবহার করছে।
কনভয়, আউটপোস্ট এবং কৌশলগত ঘাঁটিগুলোতে পিডিএফ-এর তীব্র গেরিলা আক্রমণ মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সম্পদ এবং ‘র্যাঙ্ক-অ্যান্ড-ফাইলের’ গুরুতর ক্ষতি করেছে, যা জান্তাকে স্থলে প্রায় কোণঠাসা করে দিয়েছে এবং বাধ্য করছে আকাশপথে যুদ্ধের ওপর বেশি নির্ভর করতে।
পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) এবং জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কৌশলগত সমন্বয় এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে, যেখান থেকে এটি পরিষ্কার যে এনইউজির সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৬০ হাজার যোদ্ধা যেকোনো মূল্যে জেনারেলদের ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশের সীমান্ত থেকে শুরু করে বামার জনগণ, সামরিক জান্তা এখন একাধিক ফ্রন্টে প্রতিপক্ষের একটি শক্তিশালী জোটের মুখোমুখি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পিডিএফ এবং জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো যদি এভাবে সামরিক জান্তার ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে পারে, তাহলে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং হার মানতে বাধ্য। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সেনাসংখ্যা, প্রতিরক্ষা সক্ষমতা, যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এবং আর্থিক সম্পদের দিক থেকে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীই প্রভাবশালী। তবে এর অর্থ এই নয় যে, সামরিক বাহিনী গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে নির্মূল করতে সক্ষম হবে। কারণ, ক্রোধ এবং ঘৃণা থেকে জান্তার প্রতি জনসমর্থন এখন তলানিতে। ফলে আগ্রাসি এই বাহিনীর মনোবলও দিন দিন কমে আসছে।
একইভাবে সহিংসতার কারণে একসময়ের প্রতিশ্রুতিশীল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার এ দেশটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। শ্রীলঙ্কা, লাওস ও পাকিস্তানের পাশাপাশি মিয়ানমারের অর্থনীতিও বড় ধরনের সংকটের মধ্যে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিক দুর্দশা মিয়ানমারে সামাজিক অসন্তোষ সৃষ্টি করছে এবং জান্তার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে আরও বেশি মানুষকে উৎসাহিত করছে।
পর্যটন খাতে ধস, দুর্বল রফতানি আয় এবং অস্ত্র ও জ্বালানি আমদানির জন্য বাড়তি খরচের কারণে জান্তার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত অনেক কারণ রয়েছে। অনুমান করা যায়, পঙ্গু অর্থনীতির কারণেই দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকতে পারবে না জান্তা সরকার।
এ ছাড়া ব্যাপক কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতার দিকেও ধাবিত হচ্ছে মিয়ানমার। পশ্চিমা দেশগুলো সাহায্য স্থগিত করেছে এবং মিয়ানমারের শীর্ষ সামরিক নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহের গতি কমিয়ে দিয়েছে রাশিয়াও, যা জান্তার ভবিষ্যৎকে ফেলেছে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে।
মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের মধ্যে অন্যতম চীন। তবে নানা কারণে জান্তার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলা কঠিন হয়ে পড়ছে তাদের জন্যও। ফলে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি অং সান সু চির দল এনএলডির সঙ্গেও সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে বেইজিং। অন্যদিকে তাতমাদো কখনোই চীনের ভূরাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে স্বচ্ছন্দ বোধ করেনি। কারণ, চীন যেকোনো সময় মিয়ানমার দখল করে নিতে পারে–এমন আতঙ্ক সবসময়ই ছিল জান্তার মনে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন হয়তো এরই মধ্যে বুঝতে পেরেছে যে স্থিতিশীলতা না এলে মিয়ানমারে বিনিয়োগ করে তাদের তেমন লাভ হবে না। ফলে নাটকীয়ভাবে দেশটিতে বেইজিংয়ের বিনিয়োগও কমে এসেছে। মিয়ানমারের সরকারি তথ্যই বলছে, এনএলডি সরকারের আমলে সেখানে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। কিন্তু ২০২১ সাল নাগাদ সেই বিনিয়োগ কমতে কমতে নেমে এসেছে প্রায় ১৭৬ মিলিয়নে।
ভবিষ্যৎ এখনও অস্পষ্ট। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের ক্ষয়ক্ষতি, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং প্রধান মিত্রদের সমর্থনের অভাব–গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি সূচকের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, জনসমর্থন বা চূড়ান্ত জয় বহুলাংশে গণতন্ত্রপন্থি শক্তির দিকেই চলে গেছে। এ জয় হয়তো এখনই আসবে না, তবে সময় যে তাদের অনুকূলে আছে–সেটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।
সূত্র: শাননিউজ