প্রথমে সংসদকে অবৈধ ঘোষণা, পরবর্তী সময়ে সেই সংসদেই শপথ; আবার পৌনে ৪ বছর পর পদত্যাগ করায় একাদশ জাতীয় সংসদ ঘিরে বিএনপির এমন অবস্থানকে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিএনপির সংসদ সদস্যরা (এমপি) বরাবরই বলে আসছেন সবকিছু হচ্ছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায়। তবে বিএনপির বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত বিশিষ্টজন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, বিদেশ থেকে চাপিয়ে দেয়া নয়; বরং দেশে থাকা শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ওপরই সিদ্ধান্তের ভার ছেড়ে দেয়া উচিত।
বিগত ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই সংসদকে অবৈধ দাবি করে শপথ না নেয়ার কথা জানিয়ে আসছিল বিএনপি। কিন্তু ২০১৯ সালের এপ্রিলে এসে দলের একটি অংশে ভিন্নমত থাকলেও নির্ধারিত সময়ের একবারে শেষ মুহূর্তে আলাদা দুদিনে শপথ নেন বিএনপির নির্বাচিত ৫ সংসদ সদস্য।
অন্যরা শপথ নিলেও বিরত থাকেন কেবল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আর সেই শপথ না নেয়ার কারণ কখনও স্পষ্ট করেনি বিএনপি। ওই সময় ২০১৯ সালের ২৬ জানুয়ারি বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ফলাফলই প্রত্যাখ্যান করেছি, সেখানে নতুন করে শপথ নেয়া, সংসদে যাওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না।
পরবর্তী সময়ে তার শূন্য আসনে উপনির্বাচনে জিতে আসেন দলেরই একজন। সংসদকে অবৈধ দাবি করলেও সংরক্ষিত নারী আসনের পদও গ্রহণ করে বিএনপি।
২০১৯ সালের ৫ মে বিএনপি মহাসচিব একই মুখে সাংবাদিকদের আবার বলেছিলেন, এমপিদের শপথ নেয়ার বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। আমাদের দুই দিকেই লড়াইটা করতে হবে। ভেতরে থেকেও কথা বলতে হবে, বাইরে থেকেও কথা বলতে হবে।
নানা গুঞ্জনের পর রোববার ১১ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন বিএনপির সংসদ সদস্যরা। নেতারা জানান, ২০১৯ সালে শপথ আর পৌনে ৪ বছরের মাথায় পদত্যাগ – দুটোই হয়েছে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বর্তমান সংসদ নিয়ে শুরু থেকেই বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি, শপথ আর পদত্যাগ সব কিছুতে সাংঘর্ষিক অবস্থায় আটকে আছে দলটি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবু আলম মো. শহীদ খান সম্প্রতি বলেন, অবৈধ সংসদ যখন বলা হচ্ছে, তখন প্রথম শপথ নেয়াই ভুল ছিল তাদের। বিএনপির যে অ্যাকশন, একটার সঙ্গে আরেকটার সাংঘর্ষিক।
বিএনপির বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, বিদেশ থেকে নির্দেশনা চাপিয়ে না দিয়ে তারেক রহমানের উচিত সিদ্ধান্তের ভার দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ওপর ছেড়ে দেয়া।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি মহাসচিব নির্বাচিত হলেন; কিন্তু শপথ নিলেন না – এতে সম্ভবত তারেক রহমানের একটা নির্দেশনা আছে। তারেক রহমান লন্ডনে বসে কলকাঠি নাড়েন। এইটা একটা ভুল কাজ হচ্ছে তাদের। আজকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, খন্দকার মোশাররফ, মঈন খান – তাদেরকে দলটা চালানোর ক্ষমতা দেয়া উচিত।
সংসদ থেকে পদত্যাগে রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা বিএনপিকে কতটা লাভবান করবে সে বিষয়েও সংশয় রয়েছে বিশ্লেষকদের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবু আলম মো. শহীদ খান আরও বলেন, এমপিদের পদত্যাগে মাঠের আন্দোলন বেগবান হবে বলে, আমার মনে হয় না। মাঠের আন্দোলন বিএনপিকে মাঠে নেমেই তৃণমূল পর্যায়ে গিয়ে করতে হবে।
এরই মধ্যে বিএনপির সদস্যদের পদত্যাগে শূন্য আসনে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচনে কথা জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
প্রসঙ্গত, গত রোববার ১১ ডিসেম্বর বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করায় একাদশ জাতীয় সংসদের ছটি সংসদীয় আসন রাতে শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে সংসদ সচিবালয়। শূন্য ঘোষণা করা আসনগুলো হলো: বগুড়া-৪ ও ৬, ঠাকুরগাঁও-৩, চাঁপাইনাবগঞ্জ-২, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও মহিলা আসন-৫০। তবে আবেদন যথাযথ না হওয়ায় মো. হারুন অর রশিদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়নি।
এর আগে সকালে পদত্যাগপত্র জমা দেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের মো. আমিনুল ইসলাম, বগুড়া-৪ আসনের মো. মোশাররফ হোসেন, বগুড়া-৬ আসনের জি এম সিরাজ, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের জাহিদুর রহমান এবং সংরক্ষিত আসনের রুমিন ফারহানা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের মো. হারুনুর রশীদ বিদেশে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের আবদুস সাত্তার অসুস্থ থাকায় সশরীরে পদত্যাগপত্র দেননি। গত শনিবার (১০ ডিসেম্বর) বিএনপির গণসমাবেশে দাঁড়িয়ে সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন বিএনপি নেতারা।