নিউক্লিয়ার ফিউশন বা পরমাণু ফিউশন পদ্ধতিতে থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় অগ্রগতি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা। এমনটাই দাবি করেছেন দেশটির জ্বালানি বিষয়ক কর্মকর্তারা। বলছেন, নিউক্লিয়ার ফিউশন গবেষণায় ‘ইতিহাস সৃষ্টি’ হয়েছে। গবেষণাগারে নিয়ন্ত্রিত নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রথমবারে মতো লেজার পদ্ধতির চেয়ে বে
উৎপাদিত বিদ্যুৎকে ‘নেট এনার্জি গেইন’ বলা হচ্ছে যা পরমাণুর ফিউশন পদ্ধতিতে পরিবেশবান্ধব ও অপরিমেয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় দুই বা ততোধিক পরমাণু একত্র হয়ে বড় একটি পরমাণু তৈরি করে। এই বিক্রিয়ায় বিপুল তাপ শক্তি উৎপাদিত হয়। হাইড্রোজেন বোমা পরমাণু ফিউশন বিক্রিয়ার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত যার ধ্বংসাত্মক রূপ ইতোমধ্যে মানবজাতি প্রত্যক্ষ করেছে।
বর্তমানে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে ফিউশন নয়, ফিশন প্রক্রিয়া ব্যবহার হয়। ফিশনের মাধ্যমে পরমাণু একত্র করার বদলে ইউরেনিয়াম পরমাণু ভেঙে শক্তি উৎপাদন করা হয়। তবে এ প্রক্রিয়ায় তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হয়, যেগুলো হাজারো বছর পরিবেশে থেকে যেতে পারে। কোনো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী হতে পারে, যেমনটা হয়েছিল ২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমায়।
সিএনএনের প্রতিবেদন মতে, ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স লাইভমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির ন্যাশনাল ইগনিশন ফ্যাসিলিটিতে বিজ্ঞানীরা সফলভাবে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। এতে যে পরিমাণ বিদ্যৎ ব্যবহার করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি মাত্রায় বিদ্যুৎ তৈরি সম্ভব হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ এই পরীক্ষায় ২.০৫ মেগাজুল বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। যা বিক্রিয়ার মাধ্যমে ৩.১৫ মেগাজুল ফিউশন বিদ্যুৎ তৈরি করে। ফলে যতটুকু বিদ্যুৎ রাখা হয়েছিল তার থেকে ৫০ শতাংশ বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেটিক সিনেটর অ্যালেক্স প্যাডিলা এই পরীক্ষাকে ‘পরিবেশবান্ধব বিদ্যুতের ভবিষ্যতের জন্য একটি ঐতিহাসিক বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও মাইলফলক বলে অভিহিত করেছেন।
সূর্যের মত নক্ষত্রে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমেই শক্তি তৈরি হয়। বহু বছর ধরে পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় সেই বিক্রিয়া ঘটানোর কৌশল উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে আসছেন বিজ্ঞানীরা। সত্যি সত্যি যদি পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটানো যায়, তাহেলে এর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উপায়ে অসীম বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এ প্রক্রিয়ায় কার্বন নির্গামন বা তিজস্ক্রিয় নিঃসরণের ঝুঁকিও তেমন বাড়বে না।
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের গবেষণা সফল হয়ে থাকলে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে আনার একটি নতুন পথ খুলতে যাচ্ছে বলে গবেষকরা আশাবাদী। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা জয়েন্ট ইউরোপিয়ান টোরাস (জেইটি) ল্যাবরেটরির গবেষকরা এ বছর ফেব্রুয়ারিতে হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটপ ব্যবহার করে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে তাপ উৎপাদনের নতুন রেকর্ড গড়ার খবর দেন।
জেইটি ল্যাবের গবেষকরা তাদের গবেষণায় ৫ সেকেন্ডে ৫৯ মেগাজুল (১১ মেগাওয়াট) শক্তি তৈরি করতে পেরেছিলেন, যা ১৯৯৭ সালে তাদের একই ধরনের গবেষণায় উৎপাদিত শক্তির দ্বিগুণেরও বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা যে প্রক্রিয়ায় কাজটি করেছেন, তাকে বলা হয় থার্মোনিউক্লিয়ার ইনারশিয়াল ফিউশন। তারা লেজারের মাধ্যমে নিউট্রনের গায়ে আইসোটপ ছুড়ে দিয়ে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন, যার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে তাপ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে কাজটি তারা করেছেন, সেটি গবেষণাগারে যন্ত্রের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে অতি ক্ষুদ্র একটি নক্ষত্রের জন্ম দেওয়ার মত। এখন সেই ফিউশন বিক্রিয়া ধরে রেখে আরও বড় পর্যায়ে শক্তি উৎপাদন এবং তা বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজে লাগানোর কৌশল তাদের উদ্ভাবন করতে হবে।
ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদুৎকেন্দ্র তৈরি করলে তাতে গ্রিনহাউস গাস নির্গমণ হবে না। স্বল্পস্থায়ী তিজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি হলেও তার পরিমাণ হবে খুবই সামান্য। এই শতকের দ্বিতীয় ভাগেই নিউক্লিয়ার ফিউশন একটি নির্ভরযোগ্য জ্বালানি উৎস হয়ে উঠতে পারে বলে আশা করছেন গবেষকরা।