গোল্ডেন বলের লড়াইয়ে মেসির সঙ্গে আছেন গ্রিজমানও
বিশ্বকাপ শুরুর আগেই ইনজুরি কাঁপিয়ে দিয়ে যায় ফ্রান্সকে। করিম বেনজেমা, পল পগবা, এনগোলো কান্তে, ক্রিস্টোফার এনকুনকুদের মতো তারকারা ইনজুরিতে ঝরে যায় বিশ্বকাপ শুরুর আগেই। অনেকেই ভেবেছিল ভাঙাচুরা এই দল নিয়ে ফ্রান্স খুব বেশিদূর যেতে পারবে না। অথচ, ইনজুরিজর্জর ফ্রান্স উঠে গেছে কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে। গোল-অ্যাসিস্টে সামনে থেকে এমবাপ্পে নেতৃত্ব দিলেও টানা দ্বিতীয় ফাইনালে ওঠার নেপথ্যে বড় অবদান রেখেছেন অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদের ফরোয়ার্ড আন্তইনে গ্রিজমান।
অফফর্মের কারণে ক্লাবের প্রথম একাদশেই অনিয়মিত হয়ে পড়েছিলেন আন্তইনে গ্রিজমান। বিশ্বকাপের দলে সুযোগ পাওয়া নিয়েও ছিল অনিশ্চয়তা। গত বিশ্বকাপের ব্রোঞ্জবল বিজয়ী তারকা কাতার বিশ্বকাপে একাদশে সুযোগ পেয়েছেন মূলত পগবা, এনকুনকু, বেনজেমার ইনজুরির কারণে। তবে রাশিয়া বিশ্বকাপের মতো স্ট্রাইকার হিসেবে নয়, কাতার বিশ্বকাপে বদলে গেছে তার ভূমিকা। কখনো স্ট্রাইকারের পেছনে সেকেন্ড স্ট্রাইকার আবার কখনো অ্যাাটকিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলছেন এই ৩১ বছর বয়সী তারকা। তবে রাশিয়া বিশ্বকাপের শিরোপা জয়ে যে অবদান রেখেছিলেন, কাতারে ফাইনাল ওঠার পেছনে গ্রিজমানের অবদান মোটেও কমেনি।
বুধবার (১৪ ডিসেম্বর) দ্বিতীয় সেমিফাইনালে মরক্কোর বিপক্ষে ২-০ গোলের জয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে গেছে ফ্রান্স। ৪ মিনিটে থিও হার্নান্দেজের গোলের পর দ্বিতীয়ার্ধে রান্দাল কলো মুয়ানির গোলে জয় নিশ্চিত করে ব্লুরা। হার্নান্দেজের প্রথম গোলটি তৈরিতে অবদান রেখেছেন গ্রিজমান। গোটা বিশ্বকাপেই ফ্রান্সের সাফল্যের নেপথ্যে আছেন অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদের এই ফরোয়ার্ড।
কাতার বিশ্বকাপের আগে ইনজুরিতে পড়ায় স্কোয়াডেই জায়গা পাননি গত বিশ্বকাপে ফ্রান্সের মাঝমাঠের ইঞ্জিন এনগোলো কান্তে ও পল পগবা। ফ্রান্সের মাঝমাঠ সামলানোর দায়িত্বটা আদ্রিয়েন র্যাবিওট ও তরুণ অউরিলিয়ে শুয়েমিনির সঙ্গে চেপেছে গ্রিজমানের ওপরই। দায়িত্বটা দারুণভাবে পালন করছেন এই ফরোয়ার্ড। এখনো গোলের দেখা না পেলেও ফ্রান্সের আক্রমণের প্রাণকেন্দ্র গ্রিজমানই। গোটা মাঠজুড়েই বিচরণ তার।
কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্পটলাইটটা ছিল কিলিয়ান এমবাপ্পের ওপর। তবে মাঠে এদিন ম্যানসিটির ইংলিশ রাইটব্যাক কাইল ওয়াকার নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলেন ৫ গোল ও ২ অ্যাসিস্ট করা এমবাপ্পেকে। তবে ইংলিশদের ছিটকে দেওয়া গোল দুটি বানিয়ে নায়ক গ্রিজমান। মূল তারকা এমবাপ্পে হলেও বিশ্বকাপে ফ্রান্সের আক্রমণ তৈরির দায়িত্বটা গ্রিজমানের কাঁধেই। দায়িত্বটা যে খুব ভালোভাবেই পালন করছেন তিনি, তার প্রমাণ পারফরম্যান্সেই। মরক্কো ম্যাচেও ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশামের আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন গ্রিজ্জি। অবদান রেখেছেন ফ্রান্সের প্রথম গোলটিতে।
কাতার বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের দৌড়ে লিওনেল মেসি এগিয়ে থাকলেও এই গ্রিজমানের সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকেই। এমবাপ্পে-জিরুদদের দারুণ সব বলের জোগান দিয়ে চলেছেন তিনি। বিশ্বকাপে ফ্রান্সের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে বোঝার উপায় নেই যে, মিডফিল্ডের সেরা দুই তারকাকে ছাড়াই খেলছে তারা। এমনকি অনেক ফুটবলবোদ্ধার মতে গত বিশ্বকাপের চেয়েও এবার পরিণত ফুটবল খেলছে ব্লুরা।
কাতার বিশ্বকাপে গোলের সুযোগ সৃষ্টিতে গ্রিজমানের ওপরে নেই কেউই। মরক্কোর বিপক্ষে সেমিফাইনাল পর্যন্ত মোট ২০টি গোলের সুযোগ তৈরি করেছেন তিনি। এরপরই আছেন আরেক ফাইনালিস্ট আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি। ৬ ম্যাচের পুরোটা সময় খেলে মেসি তৈরি করেছেন ১৮টি সুযোগ। তবে মেসি টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ৫ গোল ও ৩ অ্যাসিস্ট করলেও এখনো কোন গোল করতে পারেননি গ্রিজমান। অবশ্য তিনি খেলছেনও অনেক নিচে। ৬ ম্যাচে তার অ্যাসিস্ট সংখ্যা ৩টি। তবে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ পারফরম্যান্সে গ্রিজমানের অবদান পরিসংখ্যান দিয়ে পুরোপুরি পরিমাপ করা সম্ভব নয়।
তারপরও সামান্য ধারণা পাওয়া যাবে এই পরিসংখ্যানে। কাতারে গ্রিজমান যে পরিমাণ গোলের সুযোগ তৈরি করেছে তা ১৯৬৬ সালের পর কোন ফরাসির জন্য চতুর্থ সর্বোচ্চ। ১৯৮২ ও ১৯৮৬ বিশ্বকাপে অ্যালাইন গ্রিজে ২৪টি করে গোলের সুযোগ তৈরি করেছিলেন। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ইয়ুরি জারকফ করেছিলেন ২১টি। এ ছাড়া ফ্রান্সের ইতিহাসে গ্রিজমানের চেয়ে বেশি অ্যাসিস্ট নেই আর কারোরই। জিদান ও অঁরিকে পেছনে ফেলার পথে অ্যাসিস্ট করেছেন ২৮টি গোলে।
২০১৮ বিশ্বকাপেও সমান উজ্জ্বল ছিলেন গ্রিজ্জি। সে বিশ্বকাপে ৪ গোল ও ৪ অ্যাসিস্ট করেও অবশ্য গোল্ডেন বল জেতা হয়নি। লুকা মদ্রিচ ও এডেন হ্যাজার্ডের পেছনে থেকে তৃতীয় সেরা হিসেবে জিতেছিলেন ব্রোঞ্জবল।
রাশিয়া বিশ্বকাপে শিরোপা জেতা ফ্রান্সের সামনে এখন সুযোগ ৬০ বছর আগের এক রেকর্ডে ভাগ বসানোর। ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে দ্বিতীয় দল হিসেবে টানা দুটি বিশ্বকাপ জিতেছিল ব্রাজিল। তারও আগে ১৯৩৪ ও ১৯৩৮ বিশ্বকাপে ইতালি প্রথম দল হিসেবে টানা দুটি বিশ্বকাপ জেতে। ফ্রান্স এবার দাঁড়িয়ে আছে সেই মাইলফলকের সামনে। মাঝখানে ব্রাজিল দ্বিতীয়বারের মতো এই কীর্তি গড়ার সুযোগ পেয়েও ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৯৪ এর শিরোপাজয়ী ব্রাজিল ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সের কাছে হেরে খুইয়েছিল সুযোগ। এবার নিজেই সেই সুযোগের সামনে ফ্রান্স। যেখানে প্রতিপক্ষ লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। শিরোপার লড়াইয়ের পাশাপাশি মেসি-গ্রিজমানের লড়াইয়েও চোখ থাকবে বিশ্বের।