কাস্তেলেরাদের তৈরি মানব পিরামিড। সূত্র: ডয়চে ভেলে
প্রতিবেশী দেশ ভারতের মহারাষ্ট্রে জন্মাষ্টমীর ‘দহি হান্ডি’ উৎসবে মানব পিরামিড এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। স্পেনের এক অঞ্চলেও প্রায় ২০০ বছর ধরে সেই ঐতিহ্য চলে আসছে। এমনকি সেখানে মানব পিরামিডের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন করা হয়। তবে এমন কসরতের ঝুঁকি কম নয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। খবর ডয়চে ভেলের।
স্পেনের তারাগোনায় বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর) মানব পিরামিডের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। খেলাটি সেখানে কাস্তেল নামে পরিচিত। যারা এটি খেলেন তাদের কাস্তেলেরা বলা হয়। তথাকথিত ‘কাস্তেল’ সেখানে শুধু একটি খেলা নয়, কাতালান সম্প্রদায়ের জাতীয় চেতনার অভিব্যক্তিও বটে। এবারের প্রতিযোগিতার ফাইনালে ১২টি টিম অংশ নিয়েছে।
চার বছর ধরে ‘হিউম্যান টাওয়ার’ বেয়ে ওপরে উঠছে ১৩ বছর বয়সী টেরেসা কার্বো। এবার তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ এসেছে। টেরেসা বলে, ‘ওপরে ওঠার সময় নিচে তাকানোর সুযোগ থাকে না। আমি সবসময় সামনের দিকে তাকাই। নিচের দিকে তাকানোর কথা ভাবিই না। শুধু নিজের কাজ করি। ব্যস, আর কিছু নয়।’
কাতালান সম্প্রদায়ের অনেকে এ খেলার সঙ্গে জড়িত। এ জন্য তাদের রয়েছে বেশ কিছু সংগঠন। এমন একটি সংগঠন ‘কাস্তেলইয়েস দে ভিলাফ্রাংকা’। ফাউস্ট সানচেস এ সংগঠনের হয়েই মানব পিরামিডের এ খেলায় অংশ নিয়েছেন।
তিনি বলেন, কাস্তেলইয়েস দে ভিলাফ্রাংকার হয়ে এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া আমার জন্য বড় সম্মানের। আমার পিতামহ শুরু করেছিলেন, আমার বাবাসহ গোটা পরিবার অংশ নিয়েছে এ খেলায়। ছোটবেলা থেকেই এ খেলা দেখে আমি অভ্যস্ত। এখানে অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। কোনোদিন ছেড়ে যাব না।’
স্পেনের তারাগোনা অঞ্চলে মানবচূড়ার এই ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে। সে সময় একাধিক গোষ্ঠীর মধ্যে এ খেলা চালু ছিল। তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মানব পিরামিডের উচ্চতাও বেড়েছে।
১৯৩২ সালে প্রথম মানব পিরামিডের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়। ২০১০ সাল থেকে এই খেলা ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। কাস্তেলেরা এভা আসেদো মনে করেন, দেখে বোঝা না গেলেও এ খেলায় বিশাল ঝুঁকি থাকে। কারণ, উচ্চতা ও ইমপ্যাক্ট অত্যন্ত বেশি। খেলা চলাকালীন অনেকের চোট পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে গত কয়েক বছরে তেমন কিছু ঘটেনি।’
কাস্তেলইয়েস দে ভিলাফ্রাংকা সংগঠনটির বাচ্চাদের প্রশিক্ষণ দেন এভা। তিনি সপ্তাহে তিন দিন তাদের সঙ্গে সময় কাটান। ২৯ বছর ধরে তিনি কাস্তেলেরা হিসেবে সক্রিয় আছেন। তিনি এই কসরতের মূলমন্ত্র ভালোই জানেন। এভার মতে, শরীরের ন্যূনতম ক্ষমতা থাকতে হবে। শরীর হালকা রাখতে পারতে হবে এবং দ্রুত নড়াচড়া করতে পারতে হবে। শরীরে গঠন অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্তরে স্থান দেয়া হয় অংশগ্রহণকারীদের। সবচেয়ে ছোটরা সবচেয়ে উঁচু স্তরে বেয়ে ওঠে।
বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে খেলা শুরু হওয়ার পর দর্শকের মাঝে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এবারের প্রতিযোগিতায় ‘কাস্তেলইয়েস দে ভিলাফ্রাংকা’ সংগঠনের ৬০০ সদস্য একসঙ্গে উপস্থিত হয়েছেন। ২০১৮ সালে শেষ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে এ সংগঠন রানার্সআপ হয়েছিল।
এ খেলায় নিচের স্তর প্রস্তুত হওয়ার পর ‘ট্রংক’ বা গুঁড়ি তৈরি করা হয়। এবারের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে একটি দলের খেলায় দেখা যায়, গুঁড়ি তৈরির পর অর্ধেক অংশ প্রস্তুত হলে সংগীত শুরু হয়। একজনের পর একজন করে একেকটি স্তর পার করে ওপরে উঠছে। তারা সব মিলিয়ে ১০টি স্তর গড়ে তুলেছে। সবার শেষে এক কিশোর টাওয়ারের শীর্ষে উঠে হাতের এক বিশেষ ভঙ্গি দেখায়।
বিচারকমণ্ডলী শুধু টাওয়ারের গঠন ও আকারের জন্যই পয়েন্ট দেয় না, সেই মানবস্তম্ভ আবার ঠিকমতো খুলে ফেলাও জরুরি। ছয় হাজারের বেশি দর্শক টানটান উত্তেজনার মধ্যে সেই কর্মকাণ্ড দেখেন। শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে সব শেষ হয়।
‘কাস্তেলইয়েস দে ভিলাফ্রাংকা’ সংগঠনটি মানব পিরামিড গঠনের ক্ষেত্রে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ৭০ বছরের এই সংঘ মোট ১২ বার এ খ্যাতি অর্জন করেছে। ফাউস্ট সানচেস বলেন, ‘কাস্তেল নিয়ে কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ার সময় কেউ ভাবেনি, সেটি কত বড় হয়ে উঠতে পারে। আমরা আরও অনেক উন্নতি করতে পারি। এখনও সে সুযোগ রয়েছে।’
কিশোরী কাস্তেলেরো হিসেবে টেরেসা কার্বো বলে, ‘আমরা জিতে যাওয়ায় আমি খুব খুশি। অনুশীলন ও মূল অনুষ্ঠানের পেছনে যাবতীয় পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। আমরা জিতেছি।’
মোটকথা কাতালুনিয়ার কাস্তেলের ঐতিহ্য বহন করতে হলে স্নায়ু শক্তিশালী হওয়া চাই।