পালকি দিয়ে শুরু ঢাকার গণপরিবহন। শুরুর দিকে ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এর ব্যবহার। পরে আস্তে আস্তে সাধারণ মানুষ পালকি ব্যবহার করতে শুরু করে। এরপর ঢাকার দিন বদলাতে থাকে ক্রমশ। চারশ’ বছরের এই পুরোনো শহর ঢাকার গণপরিবহনে আসে আমূল পরিবর্তন।
এবার ঢাকার রাস্তায় গড়াল আধুনিক গণপরিবহন মেট্রোরেলের চাকা। এতে দুই কোটি মানুষের নগরীতে চলাচলে ভোগান্তি কমে আসবে বলে ব্যাপকভাবে আশা করা হচ্ছে।
স্থপতি ইকবাল হাবীব মনে করেন, মেট্রোরেল ঢাকাকে সামগ্রিক গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার দুয়ার উন্মোচন করেছে। কারণ এটি একটি নিরাপদ এবং যুতসই আধুনিক বাহন। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় সব বাধা ডিঙিয়ে উন্নয়নের মহাসড়কে আরেক ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ।
এই নগরবিদ বলেন, এরপর যদি ইলেকট্রিক বাস নামে, পাশাপাশি প্রশস্ত ফুটপাত চালু হয়, তাহলে তা মানুষের জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকার হবে।
তার মতে, মেট্রোরেল চালুর পর তার উপযোগিতাও নিশ্চিত করতে হবে। এরসঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের একটি কঠোর রাজনৈতিক মনোভাব তৈরি করতে হবে। শহরগুলোকে বাসের জন্য অবমুক্ত আর ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য কঠিন করে তুলতে হবে। সিঙ্গাপুরে যেটি আছে।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেট্রোরেল চালু হওয়ায় বাস মালিকরা হোঁচট খাবেন। তারা সেবা বাড়াতে বাধ্য হবেন। যৌক্তিক ভাড়া আদায়ের চেষ্টা করবেন। এতে নগর পরিবহনের নৈরাজ্য মারাত্মকভাবে কমে আসবে।
দেশের প্রথম মেট্রোরেল চালুর মাধ্যমে দুর্বার গতিতে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করে বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতি সারা বিশ্বে মর্যাদা পেয়েছে। আমরা আজকে আরেকটি নতুন অহংকারের পালক বাংলাদেশের মুকুটে সংযোজিত করলাম।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ছয় মাসের মাথায় দেশের যোগাযোগ খাতে আরেকটি মাইলফলক স্থাপিত হয়েছে মেট্রোরেল বাস্তবায়নের মাধ্যমে। ২০০৫ সালে ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। তখন থেকেই ঢাকার গণপরিবহনের একটি স্বপ্নের উপকরণ বাড়তে থাকে। রাজধানীর জন্য তৈরি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) মেট্রোরেলের কথা বলা হয়েছিল।
২০১৬ সালে বেগম রোকেয়া সরণিতে সড়কের মাঝে কংক্রিটের ব্লকের বেড়া দিয়ে শুরু হয় এই প্রকল্পের কাজ। ছয় বছর পর বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে সেই স্বপ্নটি। বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সাধারণ যাত্রীরা অবশ্য মেট্রোরেলে চড়তে পারবেন বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে। এটি বাংলাদেশের প্রথম বিদ্যুৎচালিত ট্রেন, চলবে সফটওয়্যারে। প্রথম যাত্রায় ট্রেনটি চালিয়েছেন মরিয়ম আফিজা নামের একজন নারী চালক। প্রথমবারের মতো যাত্রীরা ভাড়া পরিশোধ করবেন কার্ড দিয়ে। উড়ালপথের প্রথম ট্রেনও মেট্রোরেল।
জাপানের তৈরি মেট্রোরেলের কোচগুলো অত্যাধুনিক। তিনতলা মেট্রোরেল স্টেশনে ওঠানামার জন্য সিঁড়ি, চলন্ত সিঁড়ি ও লিফট থাকছে। ট্রেন ও স্টেশন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। মেট্রোরেলের জন্য দিয়াবাড়ি ও মতিঝিল সাবস্টেশনে জাতীয় গ্রিড থেকে সরাসরি বিদ্যুৎ-সংযোগের ব্যবস্থা রয়েছে। বিকল্প সংযোগও থাকছে অবশ্য।
জাতীয় গ্রিড বিপর্যস্ত হলে পরের স্টেশনে ট্রেন যাবে ব্যাটারিতে। দুই দিকেই চলতে পারায় ঘোরানোর দরকার পড়ে না ট্রেনটি। উন্নত দেশগুলোতে বহু আগ থেকেই মেট্রোরেল আছে। প্রতিবেশী ভারত-পাকিস্তানেও আছে। এবার ঢাকায় মেট্রোরেল হওয়ায় যানজটের ভোগান্তি থেকে রেহাই পাবেন নগরবাসীরা। এতে শহরের সার্বিক গণপরিবহন ব্যবস্থারও উন্নতি ঘটবে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার। এতে উত্তর থেকে মতিঝিল যেতে সময় লাগে চার ঘণ্টা। উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ কিলোমিটারের কিছু বেশি পথে মেট্রোরেল নির্মাণ করা হয়েছে। এটি লাইন-৬ নামে পরিচিত। আজ চালু হওয়া মেট্রোরেল লাইনের উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত দূরত্ব পৌনে ১২ কিলোমিটার।
মেট্রোরেল স্টেশন থেকে যাত্রী পরিবহনের জন্য ৩০টি ডাবল ডেকার বাস পরিচালনা করবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি)। এর মধ্যে ২০টি বাস ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ ও গুলিস্তান হয়ে আগারগাঁও-মতিঝিল রুটে এবং ১০টি বাস উত্তরার হাউস বিল্ডিং থেকে আবদুল্লাহপুর হয়ে উত্তরার দিয়াবাড়ির উত্তর স্টেশন পর্যন্ত চলাচল করবে। সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) মেট্রোরেল প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) মেট্রোরেল নির্মাণ করছে এবং প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে।