টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তবুও বিদায়ী বছর ২০২২-এ এই দলটিকে মোকাবিলা করতে হয়েছে অন্তহীন সমস্যা। কিন্তু দলের প্রধান শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সব ঝঞ্ঝাট মোকাবিলা করেছে দক্ষতার সাথে। তিনি দেশেকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন অপ্রতিরোধ্যভাবে।
দেশি ষড়যন্ত্র আর নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ২০২২ পুরোটা জুড়েই আওয়ামী লীগ যেন ছিল এক অদম্য যাত্রায় অতন্দ্র প্রহরী। সাংগঠনিক দৃঢ়তা আর অবিচল নেতৃত্ব যেন আগের চেয়েও আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী করেছে, করেছে অপ্রতিরোধ্য।
আওয়ামী লীগ যে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল, তার প্রমাণ এ বছরই সবচেয়ে বেশি মিলেছে। বিরোধীদলগুলো রাজপথে আন্দোলনে নেমেও টিকতে পারেনি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দক্ষতার কারণে।
স্বপ্নের পদ্মাসেতু হোক কিংবা যানযটের শহরে জাদুর মেট্রোরেল; কর্ণফুলী টানেল হোক অথবা একদিনে শত সেতু উদ্বোধন—বছরটাই ছিল যেন আওয়ামী লীগের অর্জনে বাঙালি জাতির উৎসবের।
এক নজরে দেখে নেয়া যাক বিদায়ী বছরে কেমন ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পথচলা-
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন
বহু আলোচনার জন্ম দেয়া নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মেয়র পদে জয় পান আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী। চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ভোটে টানা তৃতীয়বারের মতো নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচিত হন তিনি।
রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তারেরর ঘোষিত ফল অনুযায়ী, মোট ১৯২টি কেন্দ্রের ফলাফলে সেলিনা হায়াৎ আইভী পান ১ লাখ ৬০ হাজারের মতো ভোট।
এই নির্বাচনে বেশ কজন প্রার্থী থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় টানা দুইবার মেয়রের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকারের মধ্যে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন
গত ১৫ জুন অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। ১০৫ কেন্দ্রে তিনি ৫০ হাজার ৩১০ ভোট পান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী টেবিল ঘড়ি প্রতীকের মনিরুল হক সাক্কু পান ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট।
পদ্মা সেতু উদ্বোধন
ষড়যন্ত্র আর প্রতিবন্ধকতাকে পেরিয়ে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে এক স্পর্ধা দেখিয়ে দিয়েছে বাঙালি। গত ২৫ জুন চালু হয় ১৮ কোটি মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রমত্তা পদ্মার বুকে নির্মিত হওয়া এ পদ্মা সেতু দাঁড়িয়ে আছে এ দেশের মানুষের সাহসের প্রতীক হয়ে। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল বিশ্বব্যাংক, অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছিল পদ্মা সেতু। কিন্তু থেমে থাকেনি এর কর্মযজ্ঞ। এ দেশের মানুষের শ্রমের টাকায় নির্মিত হয়েছে বহুমুখী এ সেতু, হাত পাততে হয়নি কারও কাছে। নির্মিত সেতুর প্রতিটি বালুকণায় লেগে আছে বাঙালির কষ্টার্জিত অর্থ। এ কেবল নিছক এক সেতু নয়, মাথা না নোয়াবার এক মূর্তিমান প্রতীক পদ্মা সেতু। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আমলে নির্মিত স্বপ্নের এ পদ্ম সেতুর কৃতিত্ব যুক্ত হয়েছে দলের পালকেও।
তৃণমূলকে চাঙা করতে ব্যস্ত ছিল আওয়ামী লীগ
করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সাল কোনো ধরনের সম্মেলন, সভা-সমাবেশ করতে পারেনি আওয়ামী লীগের নেতারা। তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে করোনা দুর্বল হলে জনজীবন স্বাভাবিক হতে থাকে। এরপরই দল গোছানোর দিকে মনোযোগ দেয় ক্ষমতাসীন দল। এরইমধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক টিম জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সফর করে বেশ কিছু সম্মেলন, বর্ধিত সভা ও কমিটি ঘোষণা করেছে।
এ ছাড়া তৃণমূলের কোন্দল নিরসনে আলাপ-আলোচনা, দিকনির্দেশনা দিয়ে দলকে চাঙা করতে বছরজুড়ে ব্যস্ত সময় পার করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
তৃণমূলের সম্মেলন
চলতি বছর ঢাকা, ফরিদপুর, দিনাজপুর, ভোলা, টাঙ্গাইল, জামালপুর, বরগুনা, কুমিল্লা মহানগর, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যশোর, ঝিনাইদহ, লক্ষ্মীপুর, পিরোজপুর, কুমিল্লা দক্ষিণ, জামালপুর, নোয়াখালী, কক্সবাজার, মাগুরা, নওগাঁ, নাটোর, মেহেরপুর, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ আরও বেশ কয়েকটি জেলায় আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া শতাধিক উপজেলা ও বেশ কয়েকটি মহানগরের সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়। তৃণমূলের এসব সম্মেলন ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
১০০ সেতু উদ্বোধন
একযোগে একশটি সড়ক সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৭ নভেম্বর গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এসব প্রকল্পের উদ্বোধন করেন তিনি।
সেতুগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৫টি, সিলেট বিভাগে ১৭, বরিশাল বিভাগে ১৪, ময়মনসিংহে ছয়, গোপালগঞ্জ, রাজশাহী ও রংপুরে পাঁচটি করে, ঢাকায় দুটি এবং কুমিল্লায় একটি রয়েছে। এসব সেতু উদ্বোধন ঘিরে সংশ্লিষ্ট জেলায় নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে।
আওয়ামী লীগের সমাবেশ
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে মহানগর, জেলা, উপজেলা ও থানা-পর্যায়ের সম্মেলন করেছে দলটি। সমান তালে চলছে প্রচার-প্রচারণাও। দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের পর দীর্ঘদিন সভা-সমাবেশ এড়িয়ে চলেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে বছরের শেষ দিকে এসে কয়েকটি বিভাগীয় শহরে জনসমাবেশে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন তিনি।
নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে যশোর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মহাসমাবেশে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। এ ছাড়া তিনি ছাত্রলীগ ও মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনেও অংশগ্রহণ করেন।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয় নিয়ে অস্বস্তি
চলতি বছরের ১৭ অক্টোবর সারা দেশে জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তিন পার্বত্য জেলা বাদে ৬১টি জেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নোয়াখালী জেলা পরিষদ নির্বাচন আদালত স্থগিত করে। ভোলা ও ফেনী জেলার সব পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন প্রার্থীরা। ২৬ জেলায় চেয়ারম্যান পদ ছাড়াও নারীদের জন্য সংরক্ষিত পদে ১৮ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ৬৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
ডা. মুরাদের পতন
এ বছরের আরেক আলোচিত নাম ডা. মুরাদ হাসান। নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ছিলেন তিনি। বিএনপি নেতা তারেক রহমানের মেয়ে জাইমা রহমানকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিকে ফোনে ধর্ষণের হুমকি দেয়ার অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তথ্য প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন মুরাদ হাসান। এরপর তাকে আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কার করা হয়। বিতর্কের মুখে দেশ ত্যাগ করলেও কানাডায় ঢুকতে না পেরে দেশে ফিরে আসেন তিনি।