১০ বছর পর পুলিশি অনুমতি নিয়ে ঢাকায় কর্মসূচি পালন করল যুদ্ধাপরাধী সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সবশেষ অনুমতি নিয়ে রাজধানীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছিল সংগঠনটি।
২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়তের তৎকালীন দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ গ্রেফতার হন। এর দুই সপ্তাহ পর একই দিনে গ্রেফতার হন দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামরুজ্জামান ও কাদের মোল্লা। মূলত এরপর থেকেই যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে মাঠে নামে জামায়াত এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে তারা।
জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব চলে দেশের নানা প্রান্তে। পুলিশকে বেধড়ক পেটানো, বোমা মেরে পুলিশের হাতের কবজি উড়িয়ে দেয়া, রেললাইন উপড়ে ফেলা, নির্বিচারে রাস্তার পাশের গাছ কেটে ফেলাসহ নানা রকম নাশকতায় মাতে তারা। এমনকি পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন দিয়ে পুলিশ সদস্যদের পুড়িয়ে মারে শিবির কর্মীরা।
এই প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর হলে প্রকাশ্য কর্মসূচি পালন এক রকম বন্ধই ছিল। তবে যখনই সুযোগ পেয়েছে, রাস্তায় নেমেছে একাত্তরের ঘাতক সংগঠনটি। নির্বিচার ভাঙচুর চালিয়েছে যানবহনে। আগুনে পুড়িয়েছে বহু মানুষের স্বপ্ন ও জীবিকা।
এদিকে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে একে একে রায় হয় বিভিন্ন মামলার। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ফাঁসির দণ্ড হয় শীর্ষ জামায়াত নেতাদের। আমৃত্যু কারাদাণ্ড হয় জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের।
গোলাম আযম এবং আলী আহসান মুজাহিদসহ কমপক্ষে তিনটি মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতে ইসলামীকে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে মন্তব্য করেন মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোট। ২০১৮ সারের ৭ ডিসেম্বর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জামায়াতে ইসলামী। তবে প্রায় ৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও আপিল নিষ্পত্তি হয়নি।
এদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে দল হিসেবে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শেষ করেছে অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট অনুযায়ী, সংগঠনের বিচার ও সাজার বিষয়টি সুস্পষ্ট না থাকায় জামায়াতের বিচার কাজ শুরু করা যাচ্ছে না।
তবে শুধু নিবন্ধন বাতিল নয়, জামায়াতকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি আছে বিভিন্ন মহলের। এ ক্ষেত্রে সরকারি তরফে বরাবরই আদালতের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, সরকার চাইলে নির্বাহী আদেশেও নিষিদ্ধ করতে পারে জামায়াতে ইসলামীকে। নজির হিসেবে তারা বলছেন, জেএমবি, হুজিবিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনকে নির্বাহী আদেশেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, সরকার যখন জামায়াতকে সভা-সমাবেশের অনুমতি দিচ্ছে, তখন এটা বোঝা যায় যে নির্বাচন সামনে রেখে মৌলবাদীদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছে। যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যায়।
তিনি আরও বলেন, জামায়াতকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া মানে জাতিকে বিপদের দিকে নেয়া।
বাংলাদেশ যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এগিয়ে যেতে চায়, তাহলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক মেসবাহ কামাল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ ছিল জামায়াতের রাজনীতি। তবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে জামায়াতকে রাজনীতির সুযোগ করে দেন জিয়াউর রহমান। এই সুযোগে ১৯৭৮ সালে অসুস্থ মাকে দেখার কখা বলে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসেন গোলাম আযম। সেই থেকে ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশে শুরু হয় যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের রাজনীতি।