প্রায়ই বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যেতেন এস.এম. সেলিম (৩৪)। কোথায় কার সঙ্গে থাকতেন এসব ব্যাপারে পরিবারের প্রশ্নে শুধু কলহই হতো, উত্তর দিতেন না। একাধিকবার স্ত্রী বৃষ্টিকে মারধর, এমনকি হত্যার চেষ্টাও করেন সেলিম। গত দুই বছরে অন্তত তিনবার পারিবারিক বৈঠক হয় সম্পর্ক বিচ্ছেদের।

তবে বৃষ্টির বাধায় পারিবারিক সে চেষ্টা ভেস্তে যায়। বৃষ্টি বলেছিলেন ‘আর কটা মাস দেখি, যদি বদলায় সেলিম’। তবে সেলিম বদলাননি। বরং পৃথিবী থেকে বৃষ্টিকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকেন তিনি।

সেই পরিকল্পনা থেকে ৩০টি ঘুমের ওষুধ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে স্ত্রীকে খাওয়ান। তবে স্ত্রী বৃষ্টির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত দুধ খেয়ে ফেলে ৯ বছরের শিশু কন্যা সানজাও। মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় মারা যান মা-মেয়ে।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে রাজধানীর মেরুল বাড্ডার নিজেদের বাসা থেকে মা-মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করে বাড্ডা থানা পুলিশ। সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয় স্বামী সেলিমকে।

পরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম মা-মেয়েকে হত্যার দায় স্বীকার করেন। তিনি, তিন দিন বাইরে থেকে পরশু

দিন রাতে বাসায় ফেরেন। এ নিয়ে পারিবারিক কলহ চরমে উঠে। পারিবারিক কলহ আর নিজের পরকীয়া সম্পর্কের জেরে স্ত্রীকে সারা জীবনের জন্য সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু মেয়েকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল না তার।

বাড্ডা থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকার খ-২১৬ নং বাসার, ফ্ল্যাট নং-৭সি এর ৮ম তলা থেকে মাহমুদা হক বৃষ্টি (৩৩) ও ৯ বছরের সানজা মারওয়া নামে মেয়েকে অবচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।

বুধবার (১৪ জুন) ভোরের দিকে এ ঘটনা ঘটে। পরে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ভোর সাড়ে ৫টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন।

বিষয়টি নিশ্চিত করে বাড্ডা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সাদেক বলেন, আশঙ্কাজনক অবস্থায় দুজনকে বনশ্রী ফরায়েজী হাসপাতালে নেওয়ার খবর পেয়ে রাত আনুমানিক তিনটার দিকে আমরা সেখানে যাই। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে চিকিৎসক মা ও মেয়েকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় স্বামী সেলিমকে আটক করা হয়।

মা-মেয়ে বিষপান করে আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রথমে আটক সেলিমের পক্ষ থেকে দাবি করলেও ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকদের বরাতে পুলিশ জানতে পারে বিষপানের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। শ্বাসরোধেও হত্যা নয়, মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধের আলামত মিলেছে। পুলিশের বিশদ জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম স্বীকার করেন দুধের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল মা-মেয়েকে।

নাতনী ও মেয়ের মৃত্যুতে হতবিহবল বাবা মো. মোজাম্মেল হক বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। ওই মামলায় বুধবার রাতে আটক সেলিমকে গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ১৪ বছর আগে পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ির মেয়ে মাহমুদা হক বৃষ্টি ও রাজধানী বাড্ডার মো. সেলিমের মধ্যে। দাম্পত্য জীবনে ৯ বছরের সানজা মারওয়া নামে মেয়ে ও সারিম নামে একটি ৯ মাসের ছেলে সন্তান আছে।

বিয়ের পর থেকে তাদের সংসার ভালোই চলছিল কিন্তু প্রায় তিন বছর পূর্বে থেকে এস.এম. সেলিম ও বৃষ্টির মধ্যে বিভিন্ন পারিবারিক বিষয়াদি নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া বিবাদ শুরু হয়।

বাবা মোজাম্মেল অভিযোগ করে বলেন, গত ১৩ জুন দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে সেলিম আমার দ্বিতীয় মেয়ে মিম আক্তারকে ফোন করে করে জানায়, মাহামুদা হক বৃষ্টি ও নাতনী সানজা কোনো সাড়া শব্দ করছে না এবং তাদের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে।

খবর পেয়ে আমার ছোট বোন ঝর্ণা আক্তার, আমার বোনজামাই পান্না এবং আমার ভাগিনা বাড্ডা ওই বাসায় গিয়ে বিছানায় বৃষ্টির নিথর দেহ দেখতে পায় এবং পাশের কক্ষে সানজার নিথর দেহ পড়েছিল।

খবর পেয়ে দ্রুত ঢাকায় আসি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে আমার মেয়ে মাহামুদা ও নাতনী সানজার মৃতদেহ দেখতে পাই। জামাই সেলিম পারিবারিক ঝগড়া বিবাদকে কেন্দ্র করে আমার মেয়ে ও নাতনীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।

নিহত বৃষ্টির মামা সোহেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেলিম একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত। সংসার তাদের ভালোই চলছিল। কিন্তু করোনাকালে তার চাকরি চলে যাওয়া পর থেকেই শুরু পারিবারিক কলহ। বাসা ভাড়ার টাকা তুলে উধাও হয়ে যেত সেলিম। একটা পর্যায়ে স্পষ্ট হয়, একাধিক নারীর সঙ্গে পরকীয়া ও অবৈধ কার্যকলাপে লিপ্ত সেলিম।

সোহেল বলেন, পারিবারিক বৈঠক হয়েছে। কিন্তু বৈবাহিক বিচ্ছেদের জন্য পরিবারের চাপেও রাজি হয়নি বৃষ্টি। বৃষ্টির বক্তব্য ছিল, আর কটা মাস দেখি। যদি বদলায় সেলিম। কিন্তু সেলিম বদলায়নি। সম্পর্কও বিচ্ছেদ করেনি। বরং সারা জীবনের জন্য আমাদের মেয়ে ও নাতনীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল।

মামা সোহেল বলেন, সেলিম প্রায়ই বৃষ্টিকে মারধর করত। গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করেছে। খারাপ লাগছে, মেয়েটা দুই সন্তানের মুখ চেয়ে সংসারটা টেনে গেছে। খারাপ লাগছে ৯ মাসের নাতিটার জন্য। এমন বয়সে মা ও বোনকে হারাতে হলো শিশু সারিমকে।

বুধবার (১৪ জুন) ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্য মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় প্রায় সময় স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হতো। আটক সেলিম পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, পরিকল্পনা করেই গত রাতে বাইরে থেকে দুধ কিনে আনে। সেই দুধে কেনা ৩০টি ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। তাতে স্ত্রী বৃষ্টি ও তার শিশু কন্যা সানজা নিস্তেজ হয়ে মারা যায়।

বাড্ডা থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেলিম প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, স্ত্রীকেই শুধু হত্যার পরিকল্পনা ছিল সেলিমের। কিন্তু ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত দুধ খেয়ে ফেলে শিশু সানজাও। যে কারণে মারা যায় সানজাও।

ওসি বলেন, একটি মামলা হয়েছে। মামলার একমাত্র আসামি সেলিম। মৃত্যুর সঠিক কারণ উঠে আসবে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে। এই ঘটনায় আরও কারো ইন্ধন ছিল কিনা তা আমরা খতিয়ে দেখছি। বিবাহিত সম্পর্কের বাইরে আর কার কার সঙ্গে মিশত সেলিম, তাদের কারো যোগসাজশ ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হবে।