চট্টগ্রাম বন্দর। ছবি:সংগৃহীত
বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, গভীর সাগর থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল খালাসের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ কাজের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে গভীর সাগর থেকে জাহাজ ঠেলে পয়েন্টে নেয়ার টাগবোট কান্ডারি এবং অয়েল ট্যাংকার পাইলটিংয়ের জন্য দক্ষ পাইলট। এতে বছরে ১০০ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরে বিশাল আকৃতির তেলের জাহাজ ভিড়িয়ে একদিকে চলছে সিঙ্গেল মুরিং পয়েন্ট বা গভীর সাগর থেকে পাইপের মাধ্যমে তেল খালাসের পরীক্ষা, অন্যদিকে চলছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিয়ে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের প্রস্তুতি। এর মধ্যে পরীক্ষামূলক অবস্থায় বয়ায় পাইপ পিটিংয়ে বাড়তি সময় লাগার পাশাপাশি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় পাইপ ছুটে যাওয়ার তথ্যও রয়েছে।
উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা কাছাকাছি চলে এলেও এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি কীভাবে ৮ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প পরিচালিত হবে। তবে পরীক্ষামূলক প্রস্তুতি হিসেবে সফলভাবে ৮২ হাজার মেট্রিক টন তেলবহনকারী প্রথম জাহাজ ভিড়িয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং পরিচালনায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল বলেন, ‘আমাদের লোকবল রয়েছে। জলযান রয়েছে। সরঞ্জাম রয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। সেখানে আমার আর মনে হয় না, আমাদের বাইরের কারো সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। আশা করি, ভবিষ্যতে আর যত জাহাজ আসবে আমরা নিজেরাই তা পরিচালনা করতে পারব।’
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা মাদার ভেসেল কিংবা অয়েল ট্যাংকারকে গভীর সাগর থেকে পাইলটিং করে বন্দরে জেটির পাশাপাশি ডলফিন জেটিতে নিয়ে আসেন পাইলটরা। গভীর সমুদ্রবন্দর মাতারবাড়িতেও চট্টগ্রামের পাইলটরা এই কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি কনজারভেটর ক্যাপ্টেন এম ফরিদুল আলম বলেন, ‘পোস্ট পাইলটির সার্ভিস, যেটিকে আমরা মুরিং সার্ভিস বলি, আমরা সেটি দেব। ফলে সরকারের বছরে ১০০ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় হবে।’
অবশ্য কান্ডারি হিসেবে পরিচিত বন্দরের এক থেকে দুটি টাগবোটের মাধ্যমেই পুশ-আপ করেই জাহাজগুলোকে জেটিতে ভেড়াতে হয়। অবশ্য সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ে ১৩০ মিটার দীর্ঘ অয়েল ট্যাংকারকে ভেড়াতে তিনটি টাগবোটের প্রয়োজন হয়।
অত্যাধুনিক টাগবোট থাকার কথা উল্লেখ করে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার মো. রুহুল আমিন বলেন, এটি দিয়ে জাহাজগুলো ভেড়ানো হয়, যা কঠিন কিছু নয়। এই এসপিএমে জাহাজ পরিচালনা করার পূর্ণ সক্ষমতা রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের।
গভীর সাগর থেকে পাইপের মাধ্যমে তেল খালাস আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলে বছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অন্তত ৮০০ কোটি টাকা যেমন সাশ্রয় হবে, তেমনি তেল খালাসের সময় ৩০ দিন থেকে মাত্র দুদিনে নেমে আসবে।
গত ২ জুলাই সৌদি আরব থেকে আনা ৮২ হাজার মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল পরীক্ষামূলক খালাস কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে গভীর বঙ্গোপসাগর থেকে পাইপলাইনে তেল খালাসের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ।
সে সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল জানিয়েছিলেন, অনেক উন্নত দেশকে টেক্কা দিয়ে গভীর সাগর থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল খালাসের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। সৌদি আরব থেকে আনা ৮২ হাজার মেট্রিক টন ক্রুড অয়েলের পরীক্ষামূলক খালাস শুরু হয়েছে গভীর বঙ্গোপসাগরে।
দেশের একমাত্র রাষ্ট্রয়াত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি বছরে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করতে সক্ষম। সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন (এসপিএম) প্রকল্প প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় ইউনিট। এটি চালু হলে পরিশোধন ক্ষমতা ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ে গভীর সাগর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার পাইপলাইন সাগরে নোঙর করা জাহাজ থেকে মহেশখালীর স্টোরেজ ট্যাংকে তেল নেয়া হবে। পাইপলাইন কমিশনিং করার পর সেখানে থাকা হেজ, সার্কিট বাল্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। এরপর স্টোরেজ থেকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত পাইপলাইন কমিশনিং করা হবে। প্রথমে ক্রুড অয়েল ও পরে ডিজেলে পাইপলাইন কমিশনিং করা হবে।
এর আগে ২০১৫ সালে পাইপলাইন বসানোর প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। মোট ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা থাকলেও, এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ তিনবার বাড়ানো হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বেড়ে ৭ হাজার ১২৫ কোটি টাকায় ঠেকেছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দিচ্ছে চীন সরকার।
এ ছাড়া বিপিসি ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার ৬০১ কোটি টাকা দিচ্ছে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে। প্রকল্পের অধীন এক সেট এসপিএম-পিএলইএম, একটি ভাসমান বয়া, ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন, এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার সাগরের তলদেশ দিয়ে এবং ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইন উপকূল দিয়ে, ২ লাখ ৮৮ হাজার ঘনমিটারের ৬টি স্টোরেজ ট্যাংক, ৩টি ব্লক ভালব স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এসপিএম প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।