১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক চালানো গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এসেছে বলে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আয়োজিত এক সম্মেলনে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা। সোমবার (৩ জুলাই) বেলজিয়ামে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একাধিক সদস্য, মানবাধিকার কর্মী ও বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক চালানো বর্বরতার চিত্র তুলে ধরা হয়। বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে সংঘঠিত গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।
হেগভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা গ্লোবাল হিউম্যান রাইট ডিফেন্স ইউরোপীয় পার্লামেন্টে এই বিষয়ে একটি সম্মেলনে আয়োজন করে। এর উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭১ সালের যে ঘটনা আজ বিশ্ব ভুলতে বসেছে তা ইউরোপসহ পুরো বিশ্ব যেন গণহত্যার স্বীকৃতি দেয় তা ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যদের বোঝানো।
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট মেম্বার ফুলভিও মারতুসিলো এই উদ্যোগ নিয়ে কনফারেন্সটি আয়োজন করেন। তবে ফ্লাইট জটিলতায় তিনি নিজে উপস্থিত হতে পারেননি। তার হয়ে বক্তব্য দেন তার প্রতিনিধি যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ গিলিয়ানা ফ্রঁকোইসা।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস উইদাউট ফ্রন্টিয়ার্সের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা ও ২ লাখ নারীকে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা থেকে বাঁচতে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল ১ কোটিরও বেশি মানুষ। অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছিল ৩ কোটি বাংলাদেশি। এমন ঘটনায় বিশ্বজুড়ে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছিল, স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল বিশ্ববাসী। সেসময় লন্ডন টাইমসের প্রতিবেদনে এই ঘটনা ‘গণহত্যা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি একজন কমান্ডারকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল, ‘আমরা পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উপড়ে ফেলতে চাই, একদম পুরোপুরিভাবে। এ জন্য যদি ২০ লাখ মানুষকে হত্যা করতে হয় এবং ৩০ বছর একে আবদ্ধ করে রাখতে হয়, তারপরও আমরা এটা করতে প্রস্তুত।’
হিউম্যান রাইটস উইদাউট ফ্রন্টিয়ার্সের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সেই হত্যার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে, তবে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা ঠিকই অর্জন করেছে। কিন্তু এই হত্যাযজ্ঞের ৫০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও আন্তর্জাতিকভাবে এই গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
সোমবার (৩ জুলাই) ব্রাসেলসে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য ইসাবেল আদিনোলফি কনফারেন্সে বাঙালি নারীদের ওপর সংঘটিত বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন। ফুলভিও মারতুসিলোর পক্ষ থেকে তিনি এক শক্তিশালী বার্তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, তার ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এখনই এর স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। পার্লামেন্ট সদস্য থিয়েরি মারিয়ানিও সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
গ্লোবাল হিউম্যান রাইটস ডিফেন্স-এর প্রেসিডেন্ট শ্রদ্ধানন্দ শীতল এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সেই যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপ বলে থাকে আর যেন এমন কিছু না হয়। কিন্তু বাংলাদেশে একদম কাঠামোগত গণহত্যা চলেছে। শুধু হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপরে নয়, বরং পুরো বাঙালি জাতির ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পল মালিক নামে একজন মানবাধিকার কর্মী জানান, তিনি শৈশবে বর্বরতার শিকার। তিনি ইউরোপীয় পার্লামেন্টকে আহ্বান জানান, যে একে বড় আকারের হত্যাযজ্ঞ নয়, বরং গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
হিউম্যান রাইটস উইদাউট ফ্রন্টিয়ার্স এর পরিচালক উইলি ফতের ব্যাখ্যা করেন, কিভাবে বছর বছর ধরে চলা হত্যাকাণ্ড গণহত্যায় রুপ নিয়েছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে আসছিল পশ্চিম পাকিস্তান। উর্দুই ছিল রাষ্ট্র ভাষা। তবে নতুন এই রাষ্ট্রের বেশির ভাগ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই উর্দুকে একমাত্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছিল।
বছরের পর বছর বাঙালিদের ওপর জাতিগত নিপীড়ন চালানো হচ্ছিল। তাদের সাহিত্য ও গানও রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭০ সালে ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর এই নিপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে বিশাল জয় লাভ করে। জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন তখন তাদের। কিন্তু তাকে সরকার গঠনের অনুমতি না দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারশেন সার্চলাইট নামে একটি অভিযানের পরিকল্পনা করে। আটক ও হত্যা করা হয় রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষার্থীদের।
সমাজকে পঙ্গু করে দিয়ে গণহত্যার পথ সুগম করতেই এই অভিযান চালানো হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এই অভিযান শুরু হয়। এরপরই শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ে তারা। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টে প্রদর্শিত এক সিনেমা দেখানো হয়। যেখানে প্রত্যক্ষদর্শী একজন তার বাবার কথা বলেন, তার অধ্যাপক বাবাকে আটক করে গুলি করে হত্যা করে ফেলে যাওয়া হয়। সেনাবাহিনীল গুলিতে মৃত্যশয্যায় থাকা চারজন প্রতিবেশীকে সাহায্য করার সময় তিনি ও তার মা অধ্যাপক বাবার লাশের খোঁজ পান। কিন্তু তখন আর চিকিৎসার সময় ছিল না।
উইলি ফবরে বলেন, অনেক মানুষ হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে যখন কোনো বিতর্ক থাকে না তখন তাকে গণহত্যা বলে আখ্যা দেওয়া যায় জেনোসাইড ওয়াচ, দ্য লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন, ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন সাইটস অব কনসাইন্স এবং ইন্টরন্যাশনা অ্যাসোসিয়েশেন অব জেনোসাইড স্কলার্স এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত মাহবুব হাসান সালেহ বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার নিয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। তাই বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিলে তা অনেক বড় পদক্ষেপ হয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ভেতরে বসে আমি আশা করছি, পার্লামেন্টের সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি প্রস্তাব করা হবে।
রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ১৯৭১ সালের ৯ মাসে বাংলাদেশে কি হয়েছে তা বিশ্ববাসীকে জানানোর দায়িত্ব প্রথমে বাংলাদেশেরই। তিনি বলেন, আমরা আশা হারাচ্ছি না। আমরা ৫২ বছর ধরে অপেক্ষা করছি। আমরা আরও অপেক্ষা করতে পারি। তবে আমরা অবশ্যই এই স্বীকৃতি পাবো।
এই কনফারেন্সের আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়েছে তিনি সবাইকে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিশ্চিতে বৈশ্বিক ক্যাম্পেইন সংহত করার আহ্বান জানানা।
সম্মেলনে আরও বক্তব্য রাখেন পোস্টভার্সার প্রেসিডেন্ট মানবাধিকার কর্মী অ্যান্ডি ভারমত। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার শিকার ও তাদের পরিবার নিয়ে কথা বলেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইউরোপীয় পার্লমেন্ট সদস্যদের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক পরামর্শক ম্যানেল সালমি। বেলজিয়ামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা এই সম্মেলনে যোগ দেন।