আলঝেইমার রোগ প্রতিরোধে ‘ডোনানেম্যাব’ ট্যাবলেটকে যুগান্তকারী বলে দাবি করছেন বিজ্ঞানীরা। ছবি: সংগৃহীত
আলঝেইমার আক্রান্ত মস্তিষ্কের কোষ ধ্বংসের গতি কমিয়ে দিতে পারে এমন একটি ওষুধ আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এলি লিলি’র তৈরি ডোনানেম্যাব নামে ওষুধটিকে এই রোগের চিকিৎসায় ‘যুগান্তকারী’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এরই মধ্যে ওষুধটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়েছে। তাতে রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা রোগীদের আলঝেইমারের গতি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে এই ওষুধ। সোমবার (১৭ জুলাই) এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে এলি লিলির কর্মকর্তারা।
এলি লিলির নিউরোসায়েন্স বিভাগের প্রেসিডেন্ট অ্যান হোয়াইট বলেছেন, ‘প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত ও রোগনির্ণয় করা গেলে এই রোগের গতিপথকে সত্যিই পরিবর্তন করতে পারে ওষুধটি।’
অ্যালঝেইমার্স রোগ বিশ্বব্যাপী দ্রুত বর্ধনশীল স্নায়বিক ব্যাধিগুলোর মধ্যে একটি। এ রোগে মস্তিষ্কের কোষগুলো ধীরে ধীরে ক্ষয় হয় বা মারা যায়। সাধারণত ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের আলঝেইমার হতে দেখা যায়। আবার কখনো কখনও অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের মধ্যেও এ সমস্যা দেখা যায়।
আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রথমে বিভ্রান্ত হন এবং অনেক কিছু ভুলে যেতে শুরু করেন। ক্রমে এটি বাড়তে থাকে; দিন দিন অবস্থা আরও খারাপ হয়। রোগটির কারণ ও এর প্রতিকার আবিষ্কারে বহুদিন ধরে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানীরা। তবে এক বছর আগেও এ রোগের চিকিৎসায় খুব একটা অগ্রগতি করতে পারেননি তারা।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদন মতে, সম্প্রতি আলঝেইমার রোগের একটি ওষুধের পরীক্ষা চালানো হয়েছে। পরীক্ষায় নতুন ওষুধটি আলঝেইমার রোগের প্রধান লক্ষণগুলো তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। যা কিছু দিন আগেও অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা এটাকে বলেছেন ‘যুগান্তকরী’ বলে অভিহিত করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানি এলি লিলি এই ওষুধটি তৈরি ও এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করে। চলতি বছরের মে মাসের শুরুর দিকে এলি লিলি এক ঘোষণায় জানায়, তারা ‘ডোনানেম্যাব’ নামে আলঝেইমার রোগের একটি ওষুধ তৈরি করেছে যা রোগের গতি প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
এলি লিলি আরও জানায়, এই পরীক্ষায় আলঝেইমার রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের আক্রান্ত ১ হাজার ৭৩৪ জন অংশ নেয়। পরীক্ষাকালে তাদেরকে মস্তিষ্কের স্বতন্ত্র ফলকগুলো সেরে না উঠা পর্যন্ত তাদের ‘ডোনানেম্যাব’ ওষুধ মাসিক আধান হিসেবে দেয়া হয়েছিল।
এলি লিলি বলছে, পরীক্ষার ফলাফল ছিল বিষ্ময়কর। দেখা যায়, রোগের গতি সামগ্রিকভাবে প্রায় ২৯ শতাংশ মন্থর হয়ে গেছে। গবেষকরা ৩৫ শতাংশ রোগীদের মধ্যে চিকিৎসায় সাড়া দেয়ার সম্ভাবনা বেশি পেয়েছেন।
যাদের ওষুধ দেয়া হয়েছিল তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কাজ যেমন, গাড়ি চালানো বা বিভিন্ন শখের কাজ করতে সক্ষম হয়েছেন। এক তৃতীয়াংশ রোগীর মধ্যে মস্তিষ্কের ফোলা একটি সাধারণ পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ছিল।
এছাড়া প্রাথমিক ভাবে মস্তিষ্ক স্ক্যানের মাধ্যমে শনাক্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত বেশির ভাগ রোগীরাই হালকা বা উপসর্গবিহীন ছিল। তবে পরীক্ষার মধ্যে ১ দশমিক ৬ শতাংশ রোগী মস্তিষ্ক ফোলার জন্য মারা গেছেন।
তবে পরীক্ষার মধ্যে আলঝেইমার রোগে দুজন স্বেচ্ছাসেবকসহ আরও একজন মস্তিষ্ক বিপজ্জনক ভাবে ফুলে যাওয়ার ফলে মারা গেছেন। ডোনানেমেব একটি অ্যান্টিবডি জাতীয় ওষুধ যা শরীরের আলঝেইমার রোগের ভাইরাসগুলোকে আক্রমণ করে। মস্তিষ্কের এক প্রকার আঠালো ভাইরাস বিটা অ্যামাইলয়েডকে ডোনানেম্যাব পরিষ্কার করার কাজ করে।
অ্যামাইলয়েড মস্তিষ্কের কোষের মধ্যবর্তী স্থানগুলোতে তৈরি হয়ে স্বতন্ত্র ফলক সৃষ্টি করা আলঝেইমার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হসপিটাল ফর নিউরোলজি অ্যান্ড নিউরোসার্জারির কগনিটিভ-ডিসঅর্ডার ক্লিনিকের ক্লিনিকাল লিড ডা. ক্যাথ মামারি বলেন, ‘আলঝেইমার রোগের গতি কমিয়ে আনার চিকিৎসার কয়েক দশকের খোঁজ বদলাতে যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন রোগের পরিবর্তনের সময়ে প্রবেশ করছি, যেখানে আমরা উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী রোগ ব্যবস্থাপনা পাবো। আলঝেইমার রোগের চিকিৎসাও তার মধ্যে একটি।’
ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি এলি লিলির ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও নিউরোসায়েন্স রিসার্চ সংস্থার প্রধান ডা. মার্ক মিন্টুন বলেন, ‘আমরা প্রয়োজনীয় সকল চিকিৎসা সুবিধাসহ আলঝেইমার রোগের ওষুধ ডোনানেমেব রোগীদের দিয়েছি। যদিও আলঝেইমার একটি মারাত্মক রোগ হওয়ায় এর বিভিন্ন ঝুঁকিও রয়েছে। আমরা আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ডোনানেম্যাবকে হাসপাতালে ব্যাবহারের জন্য অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু করব।’