স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা মার্কিন বিলিয়নিয়ার ইলন মাস্ক। ছবি: সংগৃহীত
এই মুহূর্তে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা সরবরাহের আগ্রহ প্রকাশ করেছে মার্কিন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী ইলন মাস্কের মহাকাশযান নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স। মূলত স্পেসএক্সের ইন্টারনেট সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান স্টারলিঙ্কের মাধ্যমে এই সেবা দেয়া হবে।
গত বুধবারই (২৬ জুলাই) স্টারলিঙ্কের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফর করেছেন। সফরকালে তারা সরকারের প্রতিনিধি ও আইসিটি বিভাগের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, সরকার ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের স্টারলিঙ্ক পরিষেবা নিয়ে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প শুরু করতে পারে।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেট কী
অনেকেরই প্রশ্ন, স্যাটেলাইট ইন্টারনেট কী? স্যাটেলাইট ইন্টারনেট বুঝতে হলে আমাদের আগে ইন্টারনেট ও এর ধরণগুলো সম্পর্কে ধারণা প্রয়োজন। ইন্টারনেট হলো ইন্টারকানেক্টড নেটওয়ার্কের সংক্ষিপ্ত রূপ। অনেকে একে নেটও বলে থাকেন। নেটওয়ার্ক তরঙ্গের মাধ্যমে অসংখ্য কম্পিউটার ডিভাইসকে একে অপরের সাথে যুক্ত করে তথ্য আদান-প্রদান করার পদ্ধতিকে ইন্টারনেট বলা হয়।
বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত ৬ ধরনের ইন্টারনেট দেখা যায়। যথা:
১. ডায়াল-আপ ইন্টারনেট : স্ট্যান্ডার্ড ফোন লাইনের মাধ্যমে যে ধরনের ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যায়, তাকে ডায়াল-আপ ইন্টারনেট বলে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোবাইলে মাত্র ১০ সেকেন্ডে ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যায়।
২. ডিজিটাল সাবস্ক্রাইবার লাইন বা ডিএসএল ইন্টারনেট: ডায়াল-আপ ইন্টারনেট অনেক সময় মন্থর গতির হয়। এজন্য বাজারে নতুন ডিএসএল ইন্টারনেট আনা হয়। এটা ডায়াল-আপ ইন্টারনেট থেকে ১০০ গুণ গতিতে কাজ করে।
৩. স্যাটেলাইট ইন্টারনেট: স্যাটেলাইট ইন্টারনেট হচ্ছে যোগাযোগমূলক স্যাটেলাইট তথা জিওস্টেশনারি উপগ্রহের সাহায্যে সংযুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া। এই সংযোগ তারবিহীন এবং দ্রুত গতিতে সার্ভিস দিতে পারে।
৪. ক্যাবল ইন্টারনেট: ক্যাবল ইন্টারনেটে ব্রডব্যান্ডের মাধ্যমে কম্পিউটার বা ল্যাটপটে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয়। এটি অনেক দ্রুত গতির ও জনপ্রিয় ইন্টারনেট।
৫. ওয়ারলেস ইন্টারনেট: দুইটা ডিভাইস পরস্পর কাছাকাছি দুরুত্বের মাধ্যমে একে অপরের সাথে সংযোগ করতে পারে তাকে ওয়ারলেস ইন্টারনেট বলে।
এবং ৬. সেলুলার ইন্টারনেট: স্মার্ট মোবাইল ফোন গুলোতে যে ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করা হয় তাকে সেলুলার ইন্টারনেট বলে। বর্তমানে এটা বেশ জনপ্রিয়।
বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলেই মানুষ ক্যাবল ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহার করে থাকে। ক্যাবল ইন্টারনেট সাধারণত সাবমেরিন ক্যাবল বা অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।
তবে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট কোনো তার ছাড়াই সরাসরি স্যাটেলাইট থেকে সেবা দেয়া হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চল বা গ্রামে যেখানে ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপন করা কঠিন, সেখানে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যেতে পারে।
স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের শুরু হয়েছে অনেক আগেই। ১৯৮০-এর মাঝামাঝি প্রায় ১০০টি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু। তারপর অনেকে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট দেয়া শুরু করে। এরপর যতই সময় গেছে, অন্যান্য প্রযুক্তির মতো এই প্রযুক্তিও উন্নত হয়েছে।
স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেট সেবা কি
ইন্টারনেটের গতি নিয়ে আমাদের অনেকেরই তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিশেষ করে যারা গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকেন। আমাদের দেশে শহরাঞ্চলেও ইন্টারনেটের গতি বেশ ধীর। এই সমস্যা সমাধানের ভাবনা থেকে স্টারলিঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন মার্কিন গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা ও মহাকাশযান নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের মালিক ইলন মাস্ক।
মূলত স্পেসএক্সের অধীনে পরিচালিত স্টারলিঙ্কের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, পৃথিবীর সকল জায়গায় উচ্চ গতির ইন্টারনেট সরবরাহ করা। বর্তমানে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করা হলেও ইল মাস্কের মতে, স্যাটেলাইট ইন্টারনেটই ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ।
স্টারলিঙ্ক মূলত জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের (ভূ-স্থির উপগ্রহ) মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার একটি প্রকল্প। স্টারলিঙ্কের মূল লক্ষ্য পৃথিবীর সকল জায়গায় উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করা। পৃথিবীর বাইরে ছোট ছোট অনেক স্যাটেলাইট পাঠিয়ে সেগুলোর মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করা হয়।
২০০৪ সালের জুনে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট নিয়ে কাজ শুরু করে ইলন মাস্কের স্পেসএক্স । ২০০৮ এসে ইএডিএস অ্যাস্ট্রিয়াম নামক অন্য একটি কোম্পানির কাছে সেট প্রজেক্ট বিক্রি করে দেয়। তারপর ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে ফের আত্মপ্রকাশ করে স্টারলিঙ্ক।
স্পেসএক্স ২০১৯ সাল থেকে স্টারলিঙ্ক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ শুরু করে। এরই মধ্যে তারা ৪ হাজার ৫১৯টি স্টারলিঙ্ক স্যাটেলাইট কক্ষপথে স্থাপন করেছে। প্রাথমিক পরিকল্পনায় প্রায় ১২ হাজার স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের কথা থাকলেও পরবর্তীতে ৪২ হাজারটি কক্ষপথে স্থাপনের কথা জানিয়েছে স্পেসএক্স। আর এর মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ইন্টারনেট সংযোগ দিয়েছে ৬০টি দেশে।
স্পেসএক্সের স্টারলিঙ্ক যেভাবে কাজ করে
স্টারলিংক এর কাজ করার পদ্ধতি অনেক চমকপ্রদ। স্টারলিঙ্ক অনেকটা স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মতো কাজ করে। পৃথিবীর বাইরে অনেকগুলো জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়েছে। পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার দূরের পৃথিবীর কক্ষপথে অবস্থিত এই স্যাটেলাইটগুলোকে জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট বলে। স্টারলিঙ্ক মূলত এই স্যাটেলাইটগুলোর মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করে।
পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে অন্য কোনো কম্পিউটারের সঙ্গে ইন্টারনেট যোগাযোগ করতে হলে প্রথমে স্টারলিঙ্ক গ্রাহকের কম্পিউটার থেকে রিকোয়েস্ট কাছাকাছি স্যাটেলাইটে যায়। এরপর সেই রিকোয়েস্ট সেলুলার নেটওয়ার্কের মতো একটা থেকে আরেকটা স্যাটেলাইট হয়ে নির্দিষ্ট সার্ভারে পৌঁছায়।
এরপর কাঙ্ক্ষিত তথ্য নিয়ে একই পদ্ধতিতে গ্রাহকের কম্পিউটারে (মোবাইল বা আইওটি) ফিরে আসে। এভাবে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয়। এমনকি দুর্গম পাহাড় বা জঙ্গলেও ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া যায়।
স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেট কানেকশন নিতে হলে টিভির ডিশ অ্যানটেনার মতো একটি অ্যানটেনা লাগাতে হয়। এই অ্যানটেনা স্যাটেলাইটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। ওই অ্যানটেনা থেকে একটি ক্যাবল গ্রাহকের ঘরে রাখা স্টারলিঙ্কের ওয়াইফাই রাউটারে লাগিয়ে ইন্টারনেট উপভোগ করা যায়।
স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেটের গতি কেমন
স্টারলিঙ্ক ছোট উপগ্রহের একটি অ্যারের (সারি) মাধ্যমে সীমাহীন উচ্চ-গতির ডেটা সরবরাহ করা যায়। এর গতি প্রতি সেকেন্ডে ১৫০ মেগাবিট (১৫০ এমবিপিএস)। স্পেসএক্স এই হার দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।
উকলা স্পিডটেস্ট অনুসারে, স্টারলিঙ্ক লিথুয়ানিয়ায় ২০২২ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ১৬০ এমবিপিএস ডাউনলোড গতি রেকর্ড করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৯১ এমবিপিএস, কানাডায় ৯৭ এমবিপিএস ও অস্ট্রেলিয়ায় ১২৪ এমবিপিএস পাওয়া গেছে। মেক্সিকোতে স্টারলিঙ্কের গতি রেকর্ড করা হয়েছে গড়ে ১০৫ দশমিক ৯১ এমবিপিএস।
স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেটে খরচ কত
স্টারলিঙ্কের দুই ধরনের সেবা রয়েছে। একটি আবাসিক সেবা। এটা আবাসিক ব্যবহারের জন্য। এক্ষেত্রে হার্ডওয়্যার তথা ডিশ ও রাউটারের জন্য এককালীন চার্জ ৫৯৯ ডলার। প্রতি মাসে সাবস্ক্রিপশন ফি ১১০ ডলার।
অপরটি বাণিজ্যিক সেবা। এই সেবায় আবাসিক সেবার দ্বিগুণ গতি পাওয়া যাবে। এর জন্য এককালীন চার্জ ২ হাজার ৫০০ ডলার। প্রতি মাসে ফি ৫০০ ডলার। যতই দিন যাবে ব্যবহারকারী বাড়বে এবং এক পর্যায়ে দাম অবশ্যই কমবে।
স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেটের সুবিধা
স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো অনেক উচ্চ গতির ইন্টারনেট। তারবিহীন, তাই কোনো প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ইন্টারনেটে বিঘ্ন ঘটায় সম্ভবনা নেই।
সাবমেরিন ক্যাবল ও ইন্টারনেট তার ছিঁড়ে সেবা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও স্টারলিঙ্কে সেই আশঙ্কা নেই। এছাড়া যেকোনো জায়গা থেকে এর ব্যবহার করা যায়। কখনও কখনও এর গতি সাধারণত প্রতিশ্রুতির তুলনায় দ্রুত হয়ে থাকে। সূত্র: সিনেট, স্পেসডটকম ও টিবিএস।