রাজনা হত্যায় অভিযুক্ত সামলমান। ছবি একুশে বিডি।
সুরমা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সপ্তম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী রাজনা হত্যা মামলায় তার আপন চাচাতো ভাই সালমান ও চাচি আইরুনেচ্ছাকে (৫২) আটক করে হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
জগন্নাথপুর ও শান্তিগঞ্জ উপজেলা সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার সুভাশীষ ধর জানান, সালমান মিয়া ও তার মা আইরুনেছা রাজনা আক্তার হত্যাকাণ্ডের পর থেকে অস্বাভাবিক আচরণ করেন। এছাড়া তাদের কথাবার্তা আচার আচরণ সন্দেহজনক ছিল। শান্তিগঞ্জ থানায় রাজনার মরদেহ উদ্ধার করে নিয়ে আসার পরে সালমানের আচার-আচরণ কথাবার্তা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে। এসবের পরে সালমানের বসতঘর থেকে বস্তা ও রড রশিসহ বিভিন্ন আলামত উদ্ধারের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়।
নিহত রাজনা আক্তারের বাবা ইসরাঈল মিয়া বলেন, তিনি ও তার আপন ভাই সিজিল মিয়া একই বাড়িতে বসবাস করলেও বছর কয়েক আগেও জায়গা জমি সংক্রান্ত বিরোধ ছিল দুই ভাইয়ের মধ্যে। সালমান মিয়া মা আইরুনেছা ও রাজনা আক্তারের মা জাহানারার বেগমের মধ্যে স্বভাবিক সুন্দর পারিবারিক সম্পর্ক ছিল না। বছর পাঁচেক আগে চুলা তৈরির মাটি সংগ্রহ করা নিয়ে দুই জা এর মধ্যে ঝগড়া হয়। এসময় আইরুনেছার নির্দেশে পুত্র সালমান তার আপন চাচি ও চাচাতো বোনকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। এঘটনায় শান্তিগঞ্জ থানায় মামলা হয়। পরে সামাজিক ও পারিবারিক সালিশ বৈঠকে ঘটনা শেষ হয়।
গেল এক বছর ধরে দুই জায়ের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এক বছর ধরে তাদের মধ্যে কোনো ঝগড়াঝাঁটি হয়নি। এর আগে নিয়মিত ঝগড়া হতো দুই জায়ের মধ্যে। রাজনা আক্তার নিখোঁজ হওয়ার প্রশ্নে ইসরাঈল মিয়া বলেন, ২১ জুলাই শুক্রবার রাতে তিনি বাড়ির পাশে হাওড়ে মাছ ধরার জন্য যান। কিন্তু ঝড়বৃষ্টির কারণে তিনি গভীর রাতে বাড়ি ফিরে আসেন। ঘরে এসে দেখেন তার দুই মেয়ে ও এক নাতিন সাজনা, রেশমা ও রাজনা একটি বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। ২২ জুলাই শনিবার ভোরে ফজরের আজানের পরে বসতঘরের পেছনে দুটি দরজা খোলা দেখতে পেয়ে স্ত্রীকে বলেন দরজা কেন খোলা। এরই মধ্যে বিছানায় চোখ গেলে দেখতে পান রাজনা আক্তার বিছানায় নেই। মেয়েকে বিছানায় দেখতে না পেয়ে স্ত্রীকে বলেন রাজনা বাথরুমে গেল কিনা তা দেখে আসার জন্য। স্ত্রী জাহানারা বাথরুমে গিয়ে দেখেন বাথরুমের দরজা খোলা কেউ রাজনা বাথরুমে নেই। রাজনা বাথরুমে না থাকার বিষয়টি তিনি স্বামীকে জানান।
পরে জাহানারা প্রাইভেট টিচারের কাছে রাজনা পড়তে গেল কিনা তা দেখে আসেন সেখানেও রাজনার কোন খোঁজ পায়নি পরিবারের সদস্যরা। সকাল হলে পাশের উপজেলা দিরাই শহর ও আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তাদের এখানেও রাজনা যায়নি। অনেক খুঁজে রাজনাকে না পেয়ে শেষ বিকেলে শান্তিগঞ্জ থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করতে যান রাজনার বাবা মা। এসময় গ্রামের এক ইউপি সদস্য ইসরাঈল মিয়াকে ফোন করে বলেন দিরাই উপজেলার শরীফপুর গ্রামের তালুকদার বাড়ির সীমানা প্রাচীরের সামনে একটি বস্তা পাওয়া গেছে বিষয়টি ইউপি সদস্য দিরাই ও শান্তিগঞ্জ থানা পুলিশকে অবহিত করেন। পরে তিনি সেখানে গিয়ে দুই থানার পুলিশের উপস্থিতিতে রাজনা আক্তারের মরদেহ সনাক্ত করেন।
রাজনা আক্তারের বড়বোন শিপা আক্তার বলেন, ২২ জুলাই শনিবার রাত সাড়ে ১১টায় শান্তিগঞ্জ থানাপুলিশ রাজনার মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। এসময় রাজনার লাশের সঙ্গে চাচাতো ভাই সালমানও আসে। এসময় সালমান অস্থিরতায় ভোগছিল। তার কথাবার্তা আচার আচরণ সন্দেহ জনক ছিল। পরদিন সকালে সে রাজনার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য আড়াই শয্যা বিশিষ্ট সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে পুলিশ। সেখানেও ছিল সালমান। ময়নাতদন্তের পরে রাজনার দাফন কাফন ও জানাজায় উপস্থিত ছিল সে।
রাজনার বোন রেশমা আক্তার বলেন, রাজনা লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায় আগ্রহী ছিল। সে স্কুলের বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশ গ্রহণ করে পুরস্কার ও সম্মাননা ক্রেস্ট পেয়েছে ছিল। তিনি নিখোঁজ হওয়ার প্রসঙ্গে বলেন, প্রতিদিন ভোরে রাজনা ফজরের আজানের সময় ঘুম থেকে ওঠে তার বাবাকে নামাজ পড়ার জন্য ডেকে দিতো। পরে টয়লেট পরিষ্কার করে ঘর ঝাড়ু দিয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করতো। বসতঘর থেকে টয়লেটের দূরত্ব ১০ ফুট হবে। পাকা টয়লেটে স্টিলের দরজা লাগানো। সেখান থেকে তাকে কেউ জোর করে ধরে নিয়ে গেলে কোন না শব্দ পাওয়া যেতো। তার ধারণা বাড়ির পরিচিত রাজনাকে ডেকে নিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে বস্তায় ভরে লাশ গুম করেছে পরে যা উদ্ধার হয়।
রাজনা ক্লাসমেট মাহমুদা আক্তার জানায়, প্রতিদিন রাজনা ও সে একসঙ্গে স্কুলে যেতো। মেয়ে হিসেবে রাজনা মিশুক ছিল। সে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানায়। প্রতিবেশী রুকিয়া বেগম বলেন, রাজনার পরিবার খুব গরিব। সহায়সম্বলহীন। রাজনা হত্যাকাণ্ডের পরে পুরো পরিবার শোকে কাতর হয়ে পড়েছে।
সুরমা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম বলেন, রাজনা আক্তার তার প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতো। সে ছাত্রী হিসেবে মেধাবী ছিল। লেখাপড়ার পাশাপাশি সে খেলাধুলায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে ছিল।
সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজন কুমার দাশ বলেন, এটি একটি ক্লুলেস হত্যাকাণ্ড ছিল। তাই সময় নিয়ে প্রাথমিক তদন্ত করা হয়েছে। প্রতিটি পদক্ষেপে পুলিশ গুরুত্ব সহকারে ঘটনাস্থল স্বজন এলাকাবাসী ও সন্দেহভাজনদের আলাদা আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। গ্রাম্য বিরোধ, কোন্দল দলাদলি, পারিবারিক কলহ, জায়গা জমির বিরোধ, দুই জায়ের মধ্যে সম্পর্ক দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক চাচাতো ভাই বোনের মধ্যে সম্পর্ক সহ অনেক বিষয় নিয়ে চুলছেরা বিশ্লেষণের পরে তাদের আটক করে মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এখন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেই পুরো ঘটনা ও ঘটনার মোটিভ সব বের হয়ে আসবে।
তিন বলেন, সালমানের একটি ইজিবাইক আছে। সে ইজিবাইকের চালক। তার রান্নাঘর ঘর থেকে সহজে মেইন রোড দিয়ে বের হওয়ায় যায়। এরকম অনেক বিষয় বিশেষ বিবেচনা করে সালমান ও তার মাকে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করে কথাবার্তায় গড়মিল পেয়ে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে।
গত ২২ জুলাই শনিবার ভোরে শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের পাথারিয়া মোড়লবাড়ি বাড়ি গ্রামের মুদি দোকানদার ইসরাঈল মিয়ার মেয়ে রাজনা আক্তার কেয়া বসতঘর থেকে নিখোঁজ হয়। নিখোঁজের ১৪ ঘণ্টা পর দিরাই উপজেলার শরীফপুর গ্রামের দিরাই মদনপুর সড়কের তালুকদার বাড়ির সীমানা প্রাচীরের পাশ থেকে নিখোঁজ রাজনা আক্তারের বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
রাজনা হত্যাকাণ্ডের পরে তার বাবা বাদী হয়ে শান্তিগঞ্জ থানা অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন ২৩ জুলাই। ২৬ জুলাই সুরমা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী এলাকাবাসী হত্যাকাণ্ডের জড়িতদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে পাথারিয়া বাজারে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসুচি পালন করে। ২৬ জুলাই আসামি সালমানকে আদালতে হাজির করে পরে আদালতের বিচারক তাকে জেল হাজতে পাঠায়। আদালতে হাজির করার সময় সালমান চিৎকার দিয়ে তার পরিবারের উদ্দেশ্যে বলে তার আশা ছেড়ে দিতে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে একটি বেসরকারি টিভির স্থানীয় প্রতিনিধিকে হত্যার হুমকি দেয়