চলতি সপ্তাহে গাজার আল আহলি আরব ব্যাপ্টিস্ট হাসপাতালে বোমা বিস্ফোরণে নারী ও শিশুসহ পাঁচ শতাধিক মানুষ নিহত হন। এই হামলার জন্য হামাস ইসরাইলকে দোষী করলেও এই দায় অস্বীকার করেছে ইসরাইল। এমন পরিস্থিতিতে এই হামলার একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।
আল-আহলি আরব হাসপাতালে হামলার জন্য গাজার ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ইসরাইলকে অভিযুক্ত করেছে। অন্যদিকে অভিযোগ অস্বীকার করে ইসরাইল দাবি করেছে, প্যালেস্টিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ-এর উৎক্ষেপণ করা একটি রকেট ভুলক্রমে হাসপাতালে পড়ে বিস্ফোরণ ঘটেছে। ইসলামিক জিহাদ এই অভিযোগ নাকচ করেছে।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিস্ফোরণে ৫০০ এরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। তবে ইসরাইলের দাবি, ফিলিস্তিনিরা নিহতের সংখ্যা ইচ্ছা করে বাড়িয়ে বলছে। অন্যদিকে মার্কিন গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর দাবি, নিহতের সংখ্যা ১০০ থেকে ৩০০ হতে পারে।
গত ৭ অক্টোবর হামাসের অতর্কিত হামলার জবাবে গাজায় হামলা শুরু করে ইসরাইলের সেনাবাহিনী। প্রধানত উঁচু ভবনগুলো টার্গেট করে বিমান হামলা চালানো হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টা ৫৯ মিনিটে গাজার আল আল আহলি আরব হাসপাতালে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী আল-আহলি আরব হাসপাতাল থেকে সবাইকে সরে যেতে বিশেষ করে সতর্কবার্তা দিয়েছিল — এমনটাই জানিয়েছে হাসপাতালটি পরিচালনাকারী অ্যাংলিকান চার্চ।
শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরের একজন মুখপাত্র জানান, তাদের কর্মীরা বিস্ফোরণস্থল থেকে প্রমাণ উদ্ধারে চেষ্টা করছে। কিন্তু ভারি বোমাবর্ষণ, জ্বালানি সংকট এবং ইসরাইলের গাজা ‘সম্পূর্ণ অবরোধ’ এ কাজে বাধা দিচ্ছে।
এদিকে আদতে কী ঘটছে তা বুঝতে আল জাজিরাসহ বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ঘটনার ভিডিও ফুটেজগুলো বিশ্লেষণ করেছে। আল জাজিরা এখনো তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত পাওয়া বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যমটি।
কী হয়েছিল সেদিন?
গত মঙ্গলবার ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টা ৫৯ মিনিটে হাসপাতালটিতে বিস্ফোরণ ঘটে। আল জাজিরা’র সরাসরি সম্প্রচারের ভিডিওতে দেখা গেছে, আকাশে একটি উজ্জ্বল আলো ওপরে উঠছে এবং তীব্রভাবে গতিপথ পরিবর্তন করে দুইবার আলোকচ্ছটার পর বিস্ফোরিত হয়েছে।
এরপর দূরে মাটিতে একটি বিস্ফোরণ দেখা যায়। তারপরই ক্যামেরার আরও কাছে দ্বিতীয় আরেকটি বড় বিস্ফোরণ দেখা যায়।
বিস্ফোরণের পর হাসপাতাল কম্পাউন্ডের অভ্যন্তরের ভিডিও ও ছবি থেকে দেখা যায়, গাড়ি পার্কিং এলাকায় প্রায় দুই ডজনের মতো গাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। চারপাশের ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সেগুলোর জানালা উড়ে গেছে। এছাড়াও দেওয়াল ও মাটিতে ছোপ ছোপ রক্ত দেখা গেছে।
ভিডিও ফুটেজ থেকে কী জানা গেছে?
আল জাজিরা’র সানাড ভেরিফিকেশন টিমের তদন্তে দেখা গেছে, বিস্ফোরণের ঘটনা রকেট মিসফায়ারের কারণে ঘটেছে— ইসরাইলের এমন দাবির সঙ্গে বিদ্যমান প্রমাণের নানা অসঙ্গতি রয়েছে।
এ ঘটনায় যেসব ভিডিও পাওয়া গেছে, সেগুলোর বিস্তারিত বিশ্লেষণের পর সানাড সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, যে আলোকচ্ছটাকে ইসরাইল রকেট মিসফায়ার হিসেবে অভিহিত করেছে, তার সঙ্গে দেশটির আয়রন ডোমের গাজা থেকে নিক্ষেপ করা একটি মিসাইল প্রতিহত করা ও মাঝ-আকাশে ধ্বংস করার বেশি মিল রয়েছে।
দুই পক্ষের উপস্থাপন করা প্রমাণ বিশ্লেষণ করে চ্যানেল ৪ জানিয়েছে, ‘মাঝ-আকাশের ওই বিস্ফোরণ আর মাটিতে ঘটা বিস্ফোরণ একই বলে কোনো প্রমাণ নেই।’
এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় ওই বিস্ফোরণের পেছনে কারা, তার কোনো অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েকটি সংস্থার ধারণা অনুযায়ী, বিস্ফোরণস্থলে তৈরি হওয়া তুলনামূলক ছোট গর্তগুলো ইসরায়েলের সচরাচর নিক্ষিপ্ত মিসাইলগুলোর সঙ্গে মেলে না। তবে ভিন্ন ধরনের গোলা ব্যবহারের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন বেলিংক্যাট-এর একটি বিশ্লেষণের কথা জানিয়ে প্যাক্স প্রটেকশন অভ সিভিলিয়ানস-এর সামরিক উপদেষ্টা মার্ক গারলাসকো উল্লেখ করেছেন, বিস্ফোরণস্থলের দৃশ্যপট ইসরাইলে ব্যবহৃত ৫০০, ১০০০ বা ২০০০ পাউন্ডের জয়েন্ট ডিরেক্ট অ্যাটাক মিউনিশন (জেড্যাম)-এর সঙ্গে মেলে না।
চ্যানেল ৪-এর যেসব সাংবাদিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন, তারাও জানান বিস্ফোরণস্থলে তৈরি হওয়া গর্ত মিসাইলের চেয়ে মর্টারের গোলার সঙ্গেই বেশি মিলেছে। আশপাশের ভবনগুলো কেবল বাইরের দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এর কাঠামোগত কোনো ক্ষতি হয়নি।
তবে তারা মাটি স্পর্শ করার আগে শূন্যে বিস্ফোরিত হওয়া কোনো মিসাইলের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়নি।
বিবিসি’র বিশ্লেষণ করা ভিডিওতে দেখা গেছে, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারির ঘটনা নিয়ে উল্লেখ করা বয়ানও অসঙ্গতিপূর্ণ। বিবিসি জানিয়েছে, ওই মুখপাত্র হাসপাতালের কাছে একটি গোরস্থান থেকে রকেট ছোড়া হয়েছে দাবি করলেও বাস্তবে হাসপাতালের কাছাকাছি স্থানে কোনো গোরস্থান নেই।
বিবিসি আরও জানিয়েছে, এ বিস্ফোরণে এখনও যে বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায়নি তা হলো মিসাইলের ভাঙা টুকরো। বিস্ফোরণস্থলে পাওয়া মিসাইল বা রকেটের ভাঙা অংশ দেখে প্রায়ই সেটি শনাক্ত করা যায়। কিন্তু আল আহলি আরব হাসপাতালে বিস্ফোরণের পর এখনও কোনো গোলা বা মিসাইলের ভাঙা অংশ পাওয়া যায়নি।
আর কোনো প্রমাণ আছে কি?
ওইদিন রাতে বিস্ফোরণ ঘটার কয়েক মিনিট পরপরই ৭টা ৯ মিনিটে টেলিগ্রামে দ্য প্যালেস্টিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ এক পোস্টে জানায়, তারা ইসরাইলের দিকে একগুচ্ছ রকেট নিক্ষেপ করেছে। বুধবার দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গোষ্ঠীটির একজন মুখপাত্র মুসাব আল-ব্রেইম বলেন, তাদের পোস্টের সময় আর রকেট নিক্ষেপের সময় ‘সবসময় একই হয় না।’
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর একজন সহযোগী (এইড) হানানিয়া নাফতালির এক্স অ্যাকাউন্টের একটি পোস্টও বেশ সন্দেহজনক। তিনি তার পোস্টে লেখেন, ‘ইসরাইলের বিমানবাহিনী গাজায় একটি হাসপাতালের অভ্যন্তরে হামাস সন্ত্রাসীদের আস্তানায় আঘাত হেনেছে।’ কিন্তু তিনি পোস্টটি তাৎক্ষণিকভাবে মুছে দেন।
এরপর রাত ১০টা ৫৮ মিনিটে ক্ষমা চেয়ে আরেক পোস্টে তিনি লেখেন, তিনি রয়টার্স-এর একটি প্রতিবেদন শেয়ার করেছিলেন, যেখানে ‘ভুলভাবে বলা হয়েছে যে, ইসরাইল হাসপাতালে হামলা চালিয়েছে। যেহেতু ইসরাইলি বাহিনী হাসপাতালে বোমাবর্ষণ করে না, তাই আমি ভেবেছিলাম ইসরাইল গাজায় হামাসের কোনো ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।’