আরবি চান্দ্রবর্ষ তথা হিজরি সনের মর্যাদাপূর্ণ মহররম মাসের ১০ তারিখ পবিত্র আশুরা। এই দিনটি ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যময়। এ দিন অন্যায়ের প্রতিবাদ ও ন্যায়ের আদর্শের জন্য আত্মত্যাগের মহিমান্বিত স্মৃতিবিজড়িত কারবালার শোকাবহ, মর্মস্পর্শী, হৃদয়বিদারক ও বিষাদময় ঘটনা সংঘটিত হয়।
সৃষ্টির আদি থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আশুরার তাৎপর্য স্বীকৃত। হিজরি সন প্রবর্তন মহররম মাসকে আরও বেশি স্মরণীয় করেছে। হজরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টি, স্থিতি, উত্থান ও অবনমন—সব ঘটনাই ঘটেছিল আশুরায়। হজরত নুহ (আ.)-এর নৌযানের যাত্রারম্ভ ও বন্যাবস্থার সমাপ্তি ছিল আশুরাকেন্দ্রিক।
নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর মুক্তি পাওয়া, হজরত ইউনুছ (আ.)-এর মাছের পেট থেকে মুক্ত হওয়া, হজরত দাউদ (আ.)-এর জালুত বাহিনীর ওপর বিজয় লাভ করা, হজরত আইয়ুব (আ.)-এর ১৮ বছর অসুস্থতার পর রোগমুক্ত হওয়া, হজরত ঈসা (আ.)-এর আসমানে উত্থানসহ বহু ঐতিহাসিক ঘটনার গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী এই আশুরা। (তাফসিরে তাবারি, ইবনে জারির)
কোরআন করিমে রয়েছে, ‘আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২, এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।’ (সুরা-৯ তাওবা, আয়াত: ৩৬) হাদিস শরিফে মহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ‘অতি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ চার মাস’ বলতে জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব মাসকে বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, সুরা-৯ তাওবা, আয়াত: ৩৬)
কারবালার চেতনা
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ বা ৬১ হিজরি সালে ১০ মহররম আশুরার দিনে ইরাকের কুফা নগরের অদূরে ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন বিন আলী (রা.) বিশ্বাসঘাতক অত্যাচারী শাসক ইয়াজিদের নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ ও পরিবেষ্টিত হয়ে পরিবার-পরিজন এবং ৭২ জন সঙ্গীসহ নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন।
বয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক তৃষ্ণার্ত নারী-পুরুষ, শিশু সদস্য একবিন্দু পানি থেকে বঞ্চিত হয়ে নিদারুণ অমানবিক অবস্থায় কারবালার অন্যায়-অসম যুদ্ধে এবং শিশুপুত্র তাঁর কোলেই শত্রুর নিক্ষিপ্ত বিষাক্ত তিরের আঘাতে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ বিসর্জন দেন। আহত অবস্থায় হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) একাকী শত্রুবাহিনীর ওপর বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অসীম সাহসিকতার সঙ্গে খণ্ড যুদ্ধ করে শহীদ হন। আধিপত্যবাদ, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর সুমহান আদর্শের জন্য আত্মত্যাগের বেদনাবিধুর ও শোকবিহ্বল ঘটনার স্মরণে প্রধানত আশুরা পালিত হয়।
হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আত্মদান মূলত অসত্য, অসুন্দর, অন্যায় ও অকল্যাণের বিরুদ্ধে সত্য-সুন্দর-ন্যায় ও কল্যাণের অনন্তকালের জন্য আদর্শিক বিজয়ের চেতনা। কারবালার চেতনা অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের চেতনা। মহররম মাস আসবে প্রতিবছর ঘুরে, আশুরা আসবে বারবার ঘুরেফিরে, কারবালার চেতনা জাগ্রত হবে প্রতিটি সংকট মুহূর্তে।
মহানবী (সা.) বলেন, ‘জালিম শাসকের সম্মুখে হক কথা বলা উত্তম জিহাদ।’ (বুখারি ও তিরমিজি)