মিয়ানমারের অর্ধেকের বেশি ভূখন্ড দখলের দাবি করেছে দেশটির জান্তা বিরোধী জাতীয় ঐক্য সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি)।এনইউজি বলছে, তাদের অনুগত পিপল’স ডিফেন্স ফোর্সেস বা পিডিএফ ও মিত্র এথিনক রিভল্যুশনারি অর্গানাইজেশনের (ইআরও) যোদ্ধারা গত এক বছর ধরে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে দেশের অর্ধেকের বেশি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়েছে।
গত সপ্তাহে মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ‘জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধ’ ঘোষণার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে এনইউজি’র ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট দুয়া লাশি লা এ কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, গত এক বছরে পিডিএফ ও ইআরও যোদ্ধাদের প্রতিরোধ লড়াইয়ের মুখে দেশের অর্ধেকের বেশি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জান্তা সরকার।
তবে একই সময়ে মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন জান্তা সরকারের প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং দাবি করেন, সেনা অভ্যুত্থানে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি হওয়ার পর দেশজুড়ে যে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, বর্তমানে তা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
গত সপ্তাহে রাশিয়া সফরকালে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম রিয়া নভোস্তিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হ্লাইং বলেন, ‘মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখন ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে আসছে।’
তিনি আরও বলেন, আগামী বছর আগস্টে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন হবে এবং সেই নির্বাচনকে সফল করতে সেনাবাহনী তার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করবে।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন সরকারকে উচ্ছেদ করে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং ওই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন। অভ্যুত্থানের পরপরই গ্রেফতার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় অং সান সুচিকে এবং তার বিরুদ্ধে আনা হয় একরাশ দুর্নীতির অভিযোগ।
মিয়ানমারের রাজধানী নেইপিদোর বিশেষ আদালতে বর্তমানে বিচার চলছে অং সান সুচির। কয়েকটি মামলায় তার সাজা ঘোষণা করে রায়ও ঘোষণা করেছেন আদালত।
অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশটিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন-বিক্ষোভ শুরু করে দেশটির গণতন্ত্রপন্থী শক্তি ও সাধারণ জনগণ। প্রথম পর্যায়ে বিক্ষোভ দমন করতে লাঠি, জলকামান, রবার বুলেট ব্যবহার করা হলেও একসময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেয় জান্তা।
দেশটির রাজনৈতিক কয়েদিদের আইনী সহায়তা দানকারী সংস্থা অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন অব পলিটিক্যাল প্রিজনার্সের (এএপিপি) তথ্য অনুযায়ী, গত দেড় বছরে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে মিয়ানমার জুড়ে ২ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং কারাগারে বন্দি করা হয়েছে অন্তত ১০ হাজার বিক্ষোভকারীকে।
এদিকে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি দমনে নিরাপত্তা বাহিনী প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার শুরুর পর গণতন্ত্রপন্থী বিভিন্ন শক্তিও নিজেদের মধ্যে সংগঠিত হওয়া শুরু করে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মিয়ানমারে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট নামে একটি ছায়া সরকার গঠিত হয়, যা মূলত দেশটিতে সক্রিয় বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দল ও জান্তাবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীসমূহের জোট।
মিয়ানমারে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে। এতে শত শত মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে মন্দির ও গির্জায়। তবে সেখানেও গোলাবর্ষণ করছে জান্তা সেনারা। এতে শিশুসহ বেশ কয়েকজন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যমগুলো এ খবর দিয়েছে।
মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর তথ্যমতে, মিয়ানমারের শান, চিন ও রাখাইন প্রদেশে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠী ও জান্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। বিভিন্ন স্থানে গোলাবর্ষণ করছে মিয়ানমার বাহিনী। এতে শত শত বেসামরিক নাগরিক আতঙ্কে ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন মন্দির-গির্জায়।
শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সকালে দক্ষিণাঞ্চলীয় শান প্রদেশের মোবাই এলাকায় একটি মন্দিরে বোমাবর্ষণ করে মিয়ানমার সেনারা। এতে দুই শিশুসহ অন্তত চার উদ্বাস্তু বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। ওই অঞ্চলে কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি ও কারেন ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স এবং জান্তা বাহিনীর মধ্যে লড়াই অব্যাহত রয়েছে।
এ অবস্থায় জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে একাট্টা হতে চলেছে মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। এরইমধ্যে রাখাইন রাজ্যের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি এবং ওয়া রাজ্যের ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মির শীর্ষ নেতারা সাক্ষাৎ করেছেন।