ইরানের রাজধানী তেহরানে ‘নৈতিক পুলিশের’ হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যু দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। দেশটির বিভিন্ন শহরে চলছে বিক্ষোভ। চলমান বিক্ষোভ-সহিংসতায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। মাশার মৃত্যুর ঘটনায় আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে ইরানের নৈতিক পুলিশ। নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত অধিকাংশ দেশে পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে প্রায় সবাই জানে। তবে ইরানের নৈতিক পুলিশ সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন। এই নৈতিক পুলিশ আসলে কী? এ বাহিনীর কাজই-বা কী? কী কারণে এই বাহিনী গঠিত হয়? এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই এবারের প্রতিবেদন।
নৈতিক (মোর্যাল) পুলিশ বলতে কী বোঝায়?
নৈতিক পুলিশ হচ্ছে কোনো একটি দেশের পুলিশের বিশেষায়িত একটি বাহিনী। যাদের কাজ হচ্ছে তাদের দেশে বিদ্যমান নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় অনুশাসন বজায় রাখা। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ নৈতিক আইন, নিয়মকানুন মেনে চলছে কি না, তা তদারক করা।
ইরানের নৈতিক বা মোর্যাল পুলিশ কারা?
ইরানের ‘নৈতিক পুলিশ’ ফারসি ভাষায় ‘গাতে-ই এরাদ’বা ‘গাইডেন্স প্যাট্রল’ নামে পরিচিত। ইরানের পুলিশ বাহিনীর একটি ইউনিট, যাদের কাজই হলো দেশটিতে বিদ্যমান কঠোর পোশাকবিধি অমান্যকারী ব্যক্তিদের আটক করে ব্যবস্থা নেয়া।
আর কোন দেশে রয়েছে?
ইরান ছাড়াও সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় নৈতিক পুলিশ রয়েছে। সৌদি আরবে ধর্মীয় পুলিশ ‘মুতাওয়া’ নামে পরিচিত।
ইরানের মোর্যাল পুলিশ গঠনের ইতিহাস
১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর নৈতিক পুলিশ আত্মপ্রকাশ করে। ‘বাসিজ’ নামে ইরানে একটি আধা সামরিক বাহিনী রয়েছে। বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় শুরুতে এই আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সম্মুখ সমরে পাঠানো হয়। ইরানের নৈতিক পুলিশ এই আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়। নৈতিক পুলিশকে সাহায্য-সহযোগিতাও করে বাসিজ। এটি এখন ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) বা ইসলামি বিপ্লবী বাহিনীর পাঁচটি ইউনিটের একটি। ইরানের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে বাসিজের সদস্য। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পোশাক ও আচরণ নজরদারি করে।
যে কারণে নৈতিক পুলিশ গঠন
১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের শুরুর দিকে ধীরে ধীরে নারীদের ইসলামি বিধি মোতাবেক পোশাক পরার জন্য নিয়ম আরোপ করে রাষ্ট্র। ইরানে ইসলামি বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খামেনি। তিনি ছিলেন হিজাবের পক্ষে। তাই বিপ্লবীরা তাদের নেতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে দেশটির সড়কে যথাযথ পোশাক না পরা নারীদের ওপর চড়াও হতেন। পরে নারীদের পোশাক পরার বিধি নিয়ে দেশটির ধর্মীয় নেতা ও মন্ত্রীদের তৈরি একাধিক বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। এসব বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকারি অফিসে কোনো নারী হিজাব ছাড়া যেতে পারবেন না। এ নিয়ে ১৯৮৩ সালে একটি আইন করা হয়। আইনে যেসব নারী ‘পর্দা’ করবেন না, তাদের ৭৪টি দোররা মারার বিধান রাখা হয়। তবে, সংস্কারপন্থি প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ খাতামির সময় দেশটির জনসম্মুখে নারীদের পোশাক ও আচরণ নিয়ন্ত্রণে এসব নিয়মনীতি কিছুটা শিথিল করা হয়। তবে খাতামির পর ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন অতি রক্ষণশীল নেতা হিসেবে পরিচিত মাহমুদ আহমাদিনেজাদ। তার সময়ই ইরানের নৈতিকতা পুলিশের নাম রাখা হয় ‘গাতে-ই এরাদ । মাহমুদের শাসনামলে দেশটিতে এই বাহিনীর তৎপরতা আরও বেড়ে যায়।
যেভাবে কাজ করে নৈতিক পুলিশ
ইরানের শীর্ষ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের ঠিক করা ইসলামি নীতি-নৈতিকতা মানুষ মানছে কি না, তা নিশ্চিত করে নৈতিক পুলিশ। এই বাহিনীর প্রতিটি ইউনিটে রয়েছে একটি করে ভ্যান। এই ভ্যানে ‘নৈতিক পুলিশের’ নারী-পুরুষ উভয় সদস্যই থাকেন। তারা শহরের ব্যস্ত সড়ক থেকে শুরু করে উন্মুক্ত স্থানগুলোতে টহল দেন। কেউ যথাযথ আচরণ না করলে কিংবা বিধি মোতাবেক পোশাক না পরলে তাদের আটক করে নৈতিকতা পুলিশ। যারা বিদ্যমান ‘নীতি’ লঙ্ঘন করেন, তাদের সতর্ক করে নোটিশ দেয়া হয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে নীতি লঙ্ঘনকারী ব্যক্তিকে আটক করে থানা বা সংশোধনাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নিয়ে গিয়ে তাদের কীভাবে পোশাক পরতে হবে, কী নৈতিক আচরণ করতে হবে, সে বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হয়। পরে পুরুষ অভিভাবকদের ডেকে তাদের জিম্মায় আটক ব্যক্তিকে ছেড়ে দেয়া হয়। নৈতিকতা পুলিশ কিছু ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘনকারী ব্যক্তিদের জরিমানা করে। তবে জরিমানার ক্ষেত্রে কোনো সাধারণ নিয়ম নেই।
নৈতিকতা পুলিশের প্রয়োজন আছে কি না?
ইরানে নৈতিক পুলিশের প্রয়োজনীয়তা আছে কি না, তা ২০০৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় অন্যতম বিতর্কের বিষয় হয়ে ওঠে। সে সময় সংস্কারপন্থি প্রার্থীরা এই বাহিনী বিলুপ্ত করার দাবি তোলেন। কিন্তু নৈতিকতা পুলিশ বিলুপ্ত করতে শেষ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ইরানের বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্যমতে, ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানী ক্ষমতায় আসার পর নৈতিক পুলিশের কর্মকাণ্ড কিছুটা কমে আসে। কিন্তু তার উত্তরসূরি অতি রক্ষণশীল নেতা ইব্রাহিম রাইসি ক্ষমতায় এলে আবারও নতুন করে নৈতিক পুলিশের তৎপরতা বেড়ে যায়। অনেক দিন ধরেই নৈতিক পুলিশ বাহিনী না রাখার দাবি জানিয়ে আসছে ইরানের সাধারণ মানুষ। এমনকি, নৈতিক পুলিশের চেক পয়েন্ট এড়িয়ে যেতে একধরনের অ্যান্ড্রয়েট অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কোনো স্থানে নৈতিক পুলিশের ভ্যান আছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়। মাশা আমিনির মৃত্যুর ঘটনায় নৈতিক পুলিশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন অর্থ দফতর বলছে, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে নিয়মিত সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে থাকে। তারা ইরানের সুশীল সমাজের সদস্য, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী, নারী অধিকারকর্মী ও দেশটির বাহাই সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর সহিংস দমনপীড়ন চালিয়ে আসছে।
জনপ্রিয়তার হাতিয়ার মোর্যাল পুলিশ?
রাইসি সরকার বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, পানি সংকট ও আঞ্চলিক উত্তেজনাসহ নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। বেড়েছে জনগণের অসন্তোষও। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান দেশব্যাপী অনেক বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়। তার ওপর দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের নৈতিক পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ, ক্ষোভ প্রকাশ করা হলেও এখনও কেন ইরানে নৈতিক পুলিশ বহাল রয়েছে, তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাইসি তার কট্টোরপন্থি সমর্থকদের খুশি করতেই নৈতিক পুলিশ বাহিনী এখনও বহাল রেখেছেন। অন্যদিকে বিক্ষোভকারীদের সমর্থন না জানালে, তাদের দাবি-দাওয়া না মানা হলে বর্তমান সরকার একটা বড় সমর্থন হারিয়ে ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।