চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ
বিশ্বজুড়ে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমছে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দামে ধস নেমেছে। প্রতিদিনই চিনি-ভোজ্যতেল এবং ছোলার বুকিং রেট প্রতি মণে একশ মার্কিন ডলারের বেশি কমছে। এ অবস্থায় আসন্ন রমজানে এসব পণ্যের বাজার দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে এখনই পণ্যগুলোর আমদানি ঋণপত্র খোলার কোনো বিকল্প নেই।
দেশে বছরে ২২ থেকে ২৩ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। আর রমজানে ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এক মাসেই আড়াই থেকে ৩ লাখ টন ভোজ্যতেলের দরকার হয়। মূলত ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে সয়াবিন তেল এবং মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে পাম তেল আমদানি করে বাংলাদেশ। গত কয়েক দিনে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেল এবং পাম তেলের বুকিং রেট প্রতি টনে অন্তত ২০০ মার্কিন ডলার কমেছে।
বর্তমানে প্রতি মণ সয়াবিন তেলের বাজার দর ৬ হাজার ৪০০ টাকা, পাম তেল ৪ হাজার ৩৫০ টাকা এবং সুপার সয়াবিন ৪ হাজার ৭০০ টাকা।
তাই রমজানের জন্য কম দামে ভোজ্যতেলের বুকিং দিতে ঋণপত্র খোলার জটিলতা দ্রুত নিরসনের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রামের আলম বিজনেস করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহেদ উল আলম বলেন, ব্যাংকের যে সুবিধাগুলো রয়েছে, সেগুলো আমাদের আমদানিকারকদের দিতে হবে। আমদানিকারকরা যদি বিশেষ করে খালাস সংকট ও এলসি সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেন, তাহলে তারা কোনো ব্যাঘাত ছাড়া পণ্য আমদানি করতে পারবেন।
এদিকে দেশে বছরে ১৮ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। তবে এর মধ্যে রমজান মাসে প্রয়োজন হয় অন্তত আড়াই লাখ টন চিনির। যার বেশির ভাগই ব্রাজিল ও থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা হয়। বর্তমান সংকটের কারণে তাই রমজানে প্রয়োজনীয় চিনির বুকিং দিতে তৎপর হলেও ডলার সংকটের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের এ এম এন্টারপ্রাইজের মালিক মাহমুদ আলম বলেন, এলসি দেয়ার জন্য সুযোগ করে দিতে হবে। পাশাপাশি ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে। এ ছাড়া গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে হবে। এগুলো নিশ্চিত করা গেলে দেশের ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিকভাবে চিনি উৎপাদন করতে পারবেন। তাহলে আর কোনো সংকট থাকবে না।
অন্যদিকে দেশে বছরের ছোলা প্রয়োজন ২ লাখ টন। এর মধ্যে পুরো রমজানেই প্রয়োজন হয় এক লাখ ২০ হাজার টন। দেশে সাধারণত মিয়ানমার, অস্ট্রেলিয়া ও তাঞ্জানিয়া থেকে ছোলা আমদানি হয়। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি ছোলার দাম ৭৫ থেকে ৯০ টাকা। তবে ছোলার দাম নিয়ে এখন থেকেই কারসাজি চলছে বলে অভিযোগ সাধারণ ব্যবসায়ীদের।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি সোলায়মান বাদশা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ছোলার দাম অনেক কম। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে সে অনুযায়ী যদি প্রত্যেক ব্যবসায়ী ছোলা আমদানি করেন, তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে। বাজারে দামও বাড়বে না।
তবে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারসাজি ঠেকাতে ওএমএস কিংবা টিসিবির কোনো বিকল্প দেখছেন না অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ সিকান্দার খান। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের পক্ষে সরকার যে ওএমএস বা খোলাবাজারে নিত্যপণ্য বিক্রি করার ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটির দিকে যদি সরকার অগ্রসর হতে থাকেন, তাহলে ব্যবসায়ীরা এ প্রস্তুতি দেখে সাবধান হবেন।
জানুয়ারি মাস থেকেই রমজানের পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলা শুরু হবে। অবশ্য ডলার সংকট কাটাতে গত জুলাই থেকে বিলাসবহুল পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে আসন্ন রমজানের ভোগ্য পণ্য আমদানিতে এই সিদ্ধান্তে কিছুটি শিথিলতার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
গত ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি এবং খেজুরের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখাসহ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য এসব পণ্যের আমদানি ঋণপত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে সংরক্ষিতব্য নগদ মার্জিনের হার ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার নির্দেশ দেয়া হলো।
ভোজ্যতেল, ছোলা, চিনির মতো অধিকাংশ ভোগ্যপণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর এ আমদানি নির্ভরতার কারণে দাম বাড়ানো জন্য সিন্ডিকেটের কারসাজি চলে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা দেন নানা অজুহাত। আসন্ন রমজানেও এ ভোগ্যপণ্য বাজার নিয়ে চলছে নানা কারসাজি। যেটি রোধ করতে হলে ডলার সংকট কাটানোর পাশাপাশি এলসি খোলাও সহজ করতে হবে। তাহলে বিদেশ থেকে যেমন অবাধে পণ্য আসতে পারবে, ঠিক তেমনি পণ্যের দামও আসবে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে।