১৬ ডিসেম্বর, ২০২২। বিজয়ের ৫১ বছর পূর্তি। হাঁটিহাঁটি পা পা করে বাংলাদেশ এক সময়কার তথাকথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে এখন উন্নয়নের বৈশ্বিক মডেল। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের গণমাধ্যমেও উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার বিজয়গাথা।
বাংলাদেশের বিজয়ের ৫১ বছর পূর্তির দিনে ভারতের প্রভাবশালী বাংলা সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয় পাতায় একটি মতামত প্রকাশ করেছে। শুরুতেই আনন্দবাজার লিখেছে, “যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের বয়স একশ বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। সুস্থ থাকলে তিনি নিশ্চয় গভীর আত্মগ্লানি বোধ করতেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে একটি নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে দেখে পঞ্চাশ বছর আগে তিনি উপহাস করে বাংলাদেশকে বলেছিলেন: ‘আ বটমলেস বাস্কেট কেস’। অথচ আজ, একান্ন বছরের স্বাধীন জীবন পার করে বাংলাদেশ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে পৃথিবীতে একটি বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে বললে অত্যুক্তি হয় না।”
হেনরি কিসিঞ্জারের সেই উক্তি মিথ্যা প্রমাণিত করেছে বাংলাদেশ। এগিয়ে গেছে দারুণভাবে। এ বিষয়টিও তুলে এনেছে আনন্দবাজার তাদের মতামত কলামে। আনন্দবাজার লিখেছে, ‘বাইরের এবং ভেতরের নানা গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট, অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ – সবকিছু মোকাবিলা করে আজ বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের যে সাফল্যময় অবস্থান, বহু উন্নয়নশীল দেশকে তা আত্মজিজ্ঞাসার আবর্তে নিক্ষেপ করতে পারে। গত তিন দশকে বিশ্বে সবচেয়ে স্থিতিশীল উন্নয়ন-গতিরেখা ধরে এগিয়েছে যেসব দেশ—বাংলাদেশ তাদের মধ্যে প্রথম দিকেই থেকেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারের বিবেচনায় সর্বোচ্চ স্থান দখল করেছে।’
বিশ্ব যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে টালমাটাল, তখন তার কিছুটা প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। তবে সেটিকে অস্বাভাবিক কিছু বলে মনে করছে না আনন্দবাজার। বরং পত্রিকাটি বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছে বছর কয়েকের মধ্যেই বাংলাদেশ আবারও তরতর করে ছুটবে।
কলকাতাভিত্তিক বহুল প্রচারিত এ বাংলা দৈনিকটি আরও লিখেছে, ‘রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের আঁচ বাংলাদেশের অর্থব্যবস্থায় লেগেছে ঠিকই, তবে বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষিতে সেটিকে অস্বাভাবিক বলা চলে না। কিসিঞ্জার যখন মন্তব্যটি করেছিলেন, তার সামনে উপস্থিত পরিস্থিতির ভিত্তিতে। কারণ, তখন সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশ চাদ, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডির সঙ্গে এক কাতারেই ছিল। আর এখন মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। দারিদ্র্য কমেছে বিপুল হারে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২৬ সালের মধ্যে নিম্ন হারের উন্নয়নশীল দেশসমূহের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথেই এগোচ্ছে বাংলাদেশ।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্ব, বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া নিয়েও আলোকপাত করেছে আনন্দবাজার। পত্রিকাটি লিখেছে, “অর্থনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতির দিকটিও কম চমকপ্রদ নয়। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতলে টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরল সম্মান লাভ করবেন শেখ হাসিনা। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দাঁড়িয়ে গৌরবসহকারে বলাই যায়, বিশ্বে দীর্ঘসময় শাসনকারী নারী প্রধানমন্ত্রী হলেন এক বাঙালি কন্যা—শেখ হাসিনা ওয়াজেদ। অত্যাশ্চর্য সব বাধা তাকে পেরোতে হয়েছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি প্রাণনাশের হুমকির সামনে দাঁড়িয়ে অকুতোভয়ে, অসামান্য দক্ষতায় দেশ শাসন করছেন। তার ‘ভিশন-২০৪১’ এরই মধ্যে দেশ-বিদেশে যথেষ্ট বাস্তবসম্মত বলে স্বীকৃত। এই ভিশনের মূলকথা হলো: বাংলাদেশ তত দিনে (২০৪১ সাল) একটি ‘উন্নত’ দেশ হবে এবং দারিদ্র্যফাঁদ থেকে দেশ মুক্ত হবে। শুনতে অতি-উচ্চাভিলাষী মনে হলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের মূল্য বোঝা যায় তার এই স্বপ্নের বিশ্বময় চর্চার গুরুত্ব থেকেই।”
পত্রিকাটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরস্থিতি নিয়েও কথা বলেছে। আনন্দবাজার লিখেছে, ‘চলতি মাসে যদিও ঢাকায় বিরোধী রাজনৈতিক দলে বিক্ষোভ-সমাবেশ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাই এই প্রসঙ্গে দুটি কথা বলা জরুরি। এক. এমন সমাবেশ যে হতে পারছে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পক্ষে তা স্বাস্থ্যকর। মুক্ত নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক আবহের সুরক্ষাই শেখ হাসিনাকে বিশ্বময় উচ্চতর মর্যাদা এনে দিতে পারে। দুই. যে পরিমাণ অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য কট্টর ইসলামি শক্তিসমূহ এই বিরোধী জমায়েতের পেছনে সক্রিয়, তা মনে রাখলে বোঝা যায় কেন আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ—এবং ভারত ও তাবৎ দক্ষিণ এশিয়ার পক্ষে অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের জন্য প্রতিবেশী দেশের সমর্থন কতটা গুরুত্বপূর্ণ, প্রধানমন্ত্রী হাসিনার মনোভাবেই তা স্পষ্ট। ভারতের দিক থেকেও গণতন্ত্রপন্থি এবং উদারপন্থি বাংলাদেশের গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কের দৃঢ়তা ও গভীরতা অতীতের মতোই ভবিষ্যতেও মুক্তধারায় প্রবাহিত হয়ে চলবে—এমন আশাই থাকুক।’