প্লাস্টিক বর্জ্যে হুমকির মুখে বাংলাদেশের পরিবেশ। এর মধ্যে পরিবেশ দূষণে নতুন যোগ হয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ‘সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক’। এ পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে প্লাস্টিক পণ্য বর্জন করে পরিবেশবান্ধব পণ্যে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশবিদরা। আর তা হলেই মাইক্রো প্লাস্টিকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে পারে বাংলাদেশ।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেই প্রতিনিয়ত প্লাস্টিক দূষণ চলছেই। বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রা কতটা ভয়াবহ তা বোঝা যায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মাইন্ডেরু ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত তথ্য থেকে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সাল থেকে ‘দ্য সেকেন্ড প্লাস্টিক ওয়েস্ট মেকারস ইনডেক্স’ নামে বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিকের ব্যবহার-দূষণ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির দেয়া তথ্যানুসারে ২০১৯ সালে বিশ্বে কেবল একবার ব্যবহার করা যায় এমন প্লাস্টিকের বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ১৩ কোটি ৩০ লাখ মেট্রিক টন। ২০২১ সালে ৬০ লাখ টন বেড়ে তা দাঁড়ায় ১৩ কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টনে।
বাংলাদেশও প্লাস্টিক দূষণের বাইরে নয়। এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স ইনডেক্স-২০২২ এর তথ্যমতে, বৈশ্বিক মোট প্লাস্টিক দূষণের ২ দশমিক ৪৭ শতাংশ হচ্ছে বাংলাদেশে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার অন্তত ৩ গুণ বেড়েছে। ২০০৫ সালে যেখানে শহরাঞ্চলে বছরে জনপ্রতি প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল মাত্র ৩ কেজি সেখানে ২০২০ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে জনপ্রতি ৯ কেজি। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
দূষণে এগিয়ে থাকলেও, দূষণরোধে পিছিয়ে থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। বাংলাদেশে যে পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয় তার অধিকাংশই ফেলা হয় আবাদি জমি, বিভিন্ন ধরনের জলাশয় এবং নদীতে। একই সঙ্গে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের সম্প্রতি করা গবেষণায় উঠে আসা ৫৬ নদী দূষণের প্রধান কারণগুলোর একটি প্লাস্টিক বর্জ্য। এ কারণে বাংলাদেশের পরিবেশ ও জনজীবন শুধু হুমকির মুখেই নয়, এতে প্রাণ সংশয়ও রয়েছে।
২০০২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলেও, সে আইন রয়েছে কাগজে-কলমেই। পলিথিন ব্যবহার বেড়েই চলেছে। আইনের সঙ্গে প্রয়োগের ফারাকটা কোথায়, সে বিষয়ে সময় সংবাদ কয়েকজন পরিবেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছে।
আরও পড়ুন: প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের কারখানা আর্থিক সংকটে
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘আইন প্রয়োগের সংকট আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াগত ত্রুটি থেকেই শুরু হয়। জনগণের প্রয়োজনে প্রণীত হয় আইন। এতে জনগণের অর্থবহ অংশগ্রহণকে বাংলাদেশে কখনই প্রাধান্য দেয়া হয় না। তাই নতুন নতুন আইন করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়নযোগ্য থাকে না। পলিথিনের উৎস, উৎপাদন, বিপণন, ব্যবহার, ব্যবস্থাপনা ও বিকল্প উপাদানের প্রাপ্যতাসহ নানাবিধ বিষয় একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রহণ ও এর নির্মোহ বাস্তবায়ন না হলে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগের সংকট থেকেই যাবে।’
শুধু তাই নয়, আইন প্রয়োগের সংকটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা অপরিকল্পিত উন্নয়ন দর্শনকে চিহ্নিত করেছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘পরিবেশের দিক থেকে আমরা সবসময় তালিকার পেছন দিকে থাকি, এর মূল কারণ হলো আমাদের উন্নয়ন দর্শন বা যে উন্নয়ন চলছে তা মোটেও পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীল নয়। আমাদের যুক্তি হচ্ছে আগে উন্নয়ন করব, পরে পরিবেশ রক্ষা করব। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, চীন-আমেরিকাও করেছে। তবে তাদের অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা যেটা ভুলে যাই, তারা যখন এটা করেছে তখন পরিবেশ এতটা উদ্বেগজনক অবস্থায় ছিল না। মানুষও এ ধরনের উন্নয়ন দর্শনের পরিমাণ সম্পর্কে জানতো না। এমনকি টেকসই উন্নয়ন পদ্ধতির বিষয়ে জানতো না। এখন মানুষের সামনে এসব বিষয় পরিষ্কার ধারণা আছে এবং পদ্ধতিগত জ্ঞানও আছে। এরপরেও ‘আগে উন্নয়ন পরে পরিবেশ’ এ দর্শন ধ্বংসাত্মক ও লুটপাটের। ফলে এ দর্শন পরিহার করে পরিবেশের প্রাণ ঠিক রেখে উন্নয়ন করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে জনদাবি তুলতে হবে। যাতে করে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো পরিবেশ রক্ষা করে উন্নয়নের অঙ্গীকার করে।’
আইনকে পাশে রেখে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক বা সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েই চলছে। বাংলাদেশেসহ বিশ্বের পরিবেশ বিষয়ক সংগঠনগুলোর একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব প্লাস্টিক ভেঙে মাইক্রো প্লাস্টিক হয়ে মিশে গেছে জলজ প্রাণীর শরীরে, বাতাসে এমনকি মায়ের বুকের দুধেও। কিন্তু এর বিকল্প কী, কীভাবে কমতে পারে এর ব্যবহার?
রি-সাইকেল তথা পুনরুৎপাদন: ২০৪০ সালের মধ্যে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ প্লাস্টিক দূষণ কমানো সম্ভব হবে যদি প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার খাতকে একটি লাভজনক শিল্প উদ্যোগে পরিণত করা সম্ভব হয়। এছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ভর্তুকি কমানো, প্লাস্টিক পণ্যের পুনর্ব্যবহারযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় মডেল এবং ব্যবসায়িক নির্দেশিকা কার্যকর করাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা অর্থনৈতিকভাবে প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারযোগ্যতার সম্ভাবনা ২১ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াবে।
পুনর্নির্মাণ এবং বৈচিত্র্যকরণ: প্লাস্টিকের মোড়ক, থলে এবং অন্যান্য প্লাস্টিকের পণ্যগুলো বিকল্প উপকরণ (যেমন কাগজ বা সহজে পঁচনশীল দ্রব্য সামগ্রী) থেকে তৈরি পণ্য দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হলে প্লাস্টিক দূষণ আরও ১৭ শতাংশ কমবে।
‘সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ’ স্লোগানে এবার বাংলাদেশে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হচ্ছে। সে পণ আনুষ্ঠানিকতাকে ছাড়িয়ে কাজে রূপ নিলে এবং বিশ্বব্যাংকসহ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আমলে নিলে প্লাস্টিক দূষণমুক্ত বাংলাদেশ পাওয়া সম্ভব বলে মত সংশ্লিষ্টদের।