আফ্রিকার অনেক দেশেই চলছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। কোথাও কোথাও সেই অস্থিতিশীলতা যুদ্ধ আবার কোথাও গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। স্থিতিশীলতা ফেরাতে সেসব দেশের অনেকগুলোতেই কাজ করছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন।
কিন্তু মিশনগুলো এসব দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফেরাতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে এই অঞ্চলের অনেক দেশই আর শান্তিরক্ষী রাখতে চাচ্ছে না। তবে শান্তিরক্ষী সরে গেলে দেশগুলোতে নতুন করে সংঘাত ও নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টি হতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশ্লেষকরা।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই জাতিসংঘ শান্তরক্ষা মিশন শুরু হয়। এরপর গত ৭৫ বছরে অসংখ্য মিশনের অধীনে ২০ লক্ষাধিক শান্তিরক্ষী কাজ করেছে এবং সেই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
শান্তিরক্ষীরা সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোতে নাজুক রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে স্থানীয় মানুষের জীবন বাঁচাতে ও সামাজিক পরিবর্তন সাধনে কাজ করেছে।
স্থানীয় বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি শান্তিরক্ষীরা সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের রাজনৈতিক সমাধানের অগ্রগতি, সংঘাত প্রতিরোধ, বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা, মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে শক্তিশালী করতে এবং সর্বোপরি টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে যাচ্ছে।
আফ্রিকায় শান্তিরক্ষা মিশন
বিশ্বের সবচেয়ে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল আফ্রিকায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন শুরু হয় ১৯৬০ সালে। এরপর গত ৬৩ বছরে মহাদেশজুড়ে ৩০টিরও বেশি শান্তিরক্ষা মিশন পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় আঞ্চলিক সংগঠনগুলোও শান্তিরক্ষা প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে একমত যে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনগুলো বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় বেশ সাহায্য করছে। তবে তারা এটাও স্বীকার করছেন, মিশনগুলোতে অনেক ত্রুটি ও বিচ্যুতি রয়েছে। যেখানে শান্তিরক্ষীরা যৌন ও অন্যান্য অধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে নিজেরাই সমস্যার অংশ হয়ে পড়ছে।
বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এক ডজনের মতো শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন রয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকই আফ্রিকায়। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, মালি, ওয়েস্টার্ন সাহারা, দক্ষিণ সুদান ও সুদানে মোট ছয়টি মিশন কাজ করছে।
এছাড়া আফ্রিকান ইউনিয়নের সাথে যৌথভাবে সুদানের দারফুরে একটি মিশন ও বিতর্কিত আবেই এলাকায় আরেকটি মিশন রয়েছে। সবমিলিয়ে ৫০ হাজারের বেশি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী এই অঞ্চলে মোতায়েন রয়েছে।
আফ্রিকার শান্তিরক্ষা মিশন নিয়ে সবশেষ তথ্য-উপাত্ত ও রিপোর্ট বলছে, বেশিরভাগ মিশনই তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে হিমশিম খাচ্ছে। শান্তিরক্ষী বাহিনী নিরাপত্তা, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমনকি বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে পারছে না।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, পুরো অঞ্চলের শান্তিরক্ষা মিশনের যে পরিস্থিতি তাতে সফলতার আশা খুবই ক্ষীণ। যেমনটা বলছেন গবেষণা সংস্থা জাতিকয় সেন্টার ফর হিউম্যান সিকিউরিটি অ্যান্ড পিস বিল্ডিং’-এর নির্বাহী পরিচালক আদিব সানি।
ডয়চে ভেলেকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘তারা (শন্তিরক্ষীরা) (আফ্রিকার) ওই দেশগুলোতে একের পর এক সহিংসতার মোকাবিলায় ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ সহিংসতা থামানোর জন্যই তাদেরকে সেখানে মোতায়েন করা হয়েছিল।’
আদিব সানির মতে, দেশগুলোতে সংঘাত ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। এসব পরিস্থিতিতে কিছু মিশন কিংকর্তব্য হয়ে পড়ছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে এই বিশ্লেষক বলেন, ‘মালির ঘটনা একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। (এখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি) ঠিক করা যায়নি। দিনদিন সহিংসতার আরও অবনতি হচ্ছে এবং সেখানে মিশনটি রয়েছে তাকে অসহায় বলে মনে হচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ অবশ্য এজন্য মিশনগুলোর পরিচালনাগত ত্রুটিকে দায়ী করছেন। কারণ মিশনগুলোকে কঠোর নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় বাহিনীর কর্মকাণ্ডকে। এছাড়া শান্তিরক্ষীদের ক্ষমতাও কম।
উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনগুলোকে আইন প্রয়োগের হাতিয়ার বিবেচনা করা হয় না। ‘নীল হেলমেট’ পরা রক্ষীদের এক আত্মরক্ষার পরিস্থিতি ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী পদক্ষেপ নেয়ার অনুমতি নেই।
যে বিষয়টি উঠে এসেছে যুদ্ধ ও সংঘাত বিষয়ক গবেষণা সংস্থা কনফ্লিক্ট রিসার্চ কনসোর্টিয়াম ফর আফ্রিকা’র গবেষক ফিদেল আমাকিয়ে ওউসু। তিনি বলেছেন, ‘আমি বলব না যে আফ্রিকায় জাতিসংঘের মিশনগুলো সবই ব্যর্থ হচ্ছে। বরং ম্যান্ডেট তথা ক্ষমতার প্রকৃতি তাদের দক্ষতা ও কার্যকারিতা সীমিত করেছে।’
জটিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতি বাস্তবতা
আফ্রিকার দেশগুলোর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি বেশ জটিল ও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা। এই অঞ্চলের সংঘাত পরিস্থিতি এমন যে কিছুক্ষণ পর কী ঘটবে তা আগে থেকে বলা কঠিন। ফলে এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে মিশনগুলোর পক্ষে কার্যকর কিছু করা কঠিন।
তাই চাইলেও শান্তিরক্ষীদের পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব হয় না। ফিদেল আমাকিয়ে ওউসু বলছেন, ‘এজন্য মনে হয় যেন তারা (শান্তিরক্ষীরা তাদের সেরাটা করছেন না। তাই মিশন বা মিশনে কর্মরত বাহিনী কতটা সক্ষম তার সেটা কথা নয়, তাদের (শান্তিরক্ষীদের) ম্যান্ডেট বা ক্ষমতার সীমার বুঝেই কাজ করতে হয়।’
অন্যদিকে আদিব সানির মতে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিষয়গুলোকে আরও জটিল করে তোলে। সানির মতে, (দেশগুলোতে) যতক্ষণ কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভাব থাকবে ততক্ষণ নতুন কিছু অর্জন করা সম্ভব হবে না।’
সানির কথায়‘একটি কারণ হল রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা। আপনি তখনই সফল হবেন যখন রাজনৈতিকভাবে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি থাকবে। যদি এই ধরনের প্রতিশ্রুতি না থাকে, তাহলে তাদের জন্য এটি খুব কঠিন হয়ে যায়।’
শান্তিরক্ষী বাহিনী নিজেই সমস্যা?
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে এক দশক ধরে চালানো শান্তিরক্ষা মিশনের ইতি টানল জাতিসংঘ। শুক্রবার (৩০ জুন) দেশটি থেকে শান্তিরক্ষী প্রত্যাহার সম্পর্কিত প্রস্তাবে সর্বসম্মতিক্রমে ভোট দিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। দেশটির নাগরিকরাও শান্তিরক্ষা মিশনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তাদের অভিযোগ, শান্তিরক্ষীরাই সংঘাত পরিস্থিতি আরও উসকে দিচ্ছে।
মালিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে মোট ১৩ হাজার সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর প্রায় ১৭০০ জন। সামরিক বাহিনীর প্রায় ১৪০০ জন এবং পুলিশ বাহিনীর প্রায় ৩০০ সদস্য। সামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের ক্ষেত্রে আফ্রিকার দেশ শাদের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তৃতীয় অবস্থানে আছে মিশর।
মিশন নিয়ে সম্প্রতি জাতিসংঘ ও মালি সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুলায়ে দিয়োপ অভিযোগ করেন, এক দশক ধরে মিশন চললেও মালিতে চলমান সহিংসতার বিস্তার বন্ধে শান্তিরক্ষীরা ব্যর্থ হয়েছে। এরপর দুই সপ্তাহ আগে শান্তিরক্ষীদের ‘যত দ্রুত সম্ভব’ সরিয়ে নিতে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানান তিনি।
মালি থেকে সেনা প্রত্যাহার ইস্যুতে রাশিয়ার বিতর্কিত ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনার বাহিনীকে দায়ী করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই কথা বলছেন বিশ্লেষকরাও। ফিদেল আমাকিয়ে ওউসুর কথায়, ‘মালির ক্ষেত্রে, আপনি বুঝতে পারবেন যে সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াগনার বাহিনীর উত্থানের কারণে জাতিসংঘের মিশনের কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে পড়ে।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফ্রিকায় রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনার বাহিনীর দাপট বেড়েছে। ২০২১ সালে রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনারের সঙ্গে মালির মিত্রতা শুরু হয়। এরপরই শান্তিরক্ষী বাহিনী গুরুত্ব হারাতে থাকে।